নিজস্ব প্রতিবেদক । ০২ ডিসেম্বর ২০২২
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির মেয়াদ এক বছর। কিন্তু সেই কমিটি চলেছে চার বছরের বেশি সময় ধরে। তবে কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়েছে মেয়াদ শেষের দুই মাস আগে। আর হল কমিটি হয়েছে মেয়াদ শেষ হওয়ার আড়াই বছর পর। সেই কমিটিতে স্থান পেয়েছে চাঁদাবাজির অভিযোগে অভিযুক্ত, ছাত্র নির্যাতনকারী, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের দায়ে বহিষ্কৃত এবং মাদকসেবীরা। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কমিটির মেয়াদকালে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলা, হলে শিক্ষার্থী নির্যাতন এবং ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। এই কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে দায়িত্বে আসা সনজিত-সাদ্দাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ কমিটি এক বছরের মধ্যে করলেও হল সম্মেলন করেন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। দীর্ঘ এই সময়ে ঝরে যায় অসংখ্য নেতাকর্মী। তবে হল কমিটি হওয়ার প্রায় ৮ মাস পর হয় হলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি। এসব কমিটিতে প্রায় অর্ধশত বিতর্কিতদেরকে পদায়ন হয়েছে।
২০১৭ সালে ঢাবির সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থী এহসান রফিক নির্যাতনে বহিষ্কৃত আহসান উল্লাহকে সিনিয়র সহসভাপতি, ফারদিন আহমেদ মুগ্ধকে ৩ নম্বর সহসভাপতি, সামিউল ইসলাম সামিকে ৪ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং রুহুল আমিন বেপারিকে ৫ নম্বর সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। বিজয় একাত্তর হলে সহ-সভাপতি পদ পেয়েছেন আয়ান হোসেন জজ। যার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে ছিনতাই মামলা রয়েছে। ছিনতাই মামলার আসামি তুষার হোসেন পান সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের সহসভাপতির পদ।
২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন শেখ মারুফ হোসেন সুজন। সূর্যসেন হলের ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তাকে দেওয়া হয়েছে সহ-সভাপতির পদ। একই হল থেকে সহসভাপতির পদ পেয়েছেন মাহমুদ অর্পণ; যার বিরুদ্ধে নারী ও ছেলে শিক্ষার্থীকে হেনস্তার অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার হন তিনি। এমন প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদ দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, হল কমিটি গঠনের ৮ মাস পর পূর্ণাঙ্গ করা হলেও সেখানে পেয়েছে এলাকার প্রাধান্য। ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ কয়েকজন নেতৃত্ব যুগান্তরকে জানান, হল কমিটি গঠনের সময় কেন্দ্রীয় দুই শীর্ষ নেতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শীর্ষ নেতার অনুসারীরাই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করেন। এদের মধ্যে একমাত্র সনজিত ছাড়া অন্য তিন নেতা বিভিন্ন অঞ্চলের সক্রিয়দেরকে দায়িত্ব প্রদান করেন। একমাত্র সনজিত চন্দ্র দাস ১৮ হলের ৮ জনকে ময়মনসিংহ থেকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এছাড়া অধিকাংশ হলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে ময়মনসিংহের শিক্ষার্থীদেরকে পদায়ন করার জন্য সনজিত চন্দ্র দাস কমিটি আটকে রাখেন।
বিভিন্ন হল সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি হলে ময়মনসিংহের বড় একটা অংশের শিক্ষার্থীকে কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছে। তাদেরকে হল কমিটিতে না রাখলে সনজিত চন্দ্র দাস কমিটির অনুমোদন দিতেন না। সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি আবিদ আল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স কমিটির সময় হলগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হতো। তবে সনজিত-সাদ্দামের ৪ বছরের কমিটিতে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। স্টুডেন্ট এগেইনেস্ট টর্চারের হিসাবমতে, গত চার বছরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করেছে। গত এক বছরে এ ঘটনা সবচেয়ে বেশি। অধিকাংশ নির্যাতনকারী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর ও ছাত্রলীগ নেতাদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, সনজিত-সাদ্দামের সময়ে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে হামলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পহেলা বৈশাখী কনসার্ট, কনসার্ট ফর অয়ন, কাওয়ালিসহ বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে টিএসসিতে কাওয়ালি গানের আসরে হামলা হয়। এর আগে গত বছরের মার্চ মাসে শহিদ মিনারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা বিদেশি অতিথিদের আগমনকে স্বাগত জানানোর অনুষ্ঠানে ঢাবি ও মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় অনুষ্ঠানের সাউন্ড সিস্টেম ভাঙা হয়। ওই হামলার জন্যও অভিযোগের তির সাদ্দাম ও তার অনুসারীদের দিকে। অন্যদিকে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তুচ্ছ ঘটনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি রুহুল আমিনকে সনজিত চন্দ্র দাসের উপস্থিতিতে মারধর করা হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভবনের ভেতরে হামলার শিকার হন তৎকালীন ভিপি নুরুল হক নূর ও তার অনুসারীরা। এ ঘটনায় সনজিত চন্দ্র দাস ও সাদ্দাম হোসাইনসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেন ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসাইন। এছাড়া বিগত কয়েক দিনে একের পর এক ইনস্টিটিউট, অনুষদের কমিটি ঘোষণা করা হচ্ছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সম্মেলনের মাধ্যমে এসব কমিটির বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা করা হয়নি।
এদিকে দায়িত্ব পালনকালে সাংগঠনিক কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছে সনজিত চন্দ্র দাসের বিরুদ্ধে। চার বছরের বড় একটা সময় অসুস্থতাসহ নানা কারণ দেখিয়ে বাড়িতে কাটিয়েছেন তিনি।
জানতে চাইলে ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস যুগান্তরকে বলেন, মানুষ তো অসুস্থ থাকতেই পারে। এতে আমার কোনো হাত নেই। তবে আমি সব সাংগঠনিক কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলাম। মূলত আমরা যারা মুজিব আদর্শে বিশ্বাসী তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপপ্রচার থাকবেই।
কমিটিতে বিতর্কিতদের পদায়নের বিষয়ে তিনি বলেন, করোনার কারণে আমাদের কমিটি করতে একটু সময় নিতে হয়েছে এটা সত্য কথা। তবে আমাদের কমিটিতে কোনো বিতর্কিতদের পদায়ন করা হয়নি। যেসব জায়গায় আমাদের সমস্যা মনে হয়েছে সেখানে আমরা গোয়েন্দা সাহায্য নিয়ে তথ্য যাচাই-বাছাই করেছি।
ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলা করার বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন বলেন, শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটানো এবং তাদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করার জন্য কাজ করছি। সে কারণে বিভিন্ন সময় মৌলবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে। ওদের বিরুদ্ধে ছাত্রীলীগের নেতা-কর্মীরা কখনোই পিছপা হননি।
শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকৃতভাবে যারা হলগুলোতে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন তাদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হৃদয়ের বন্ধন রয়েছে। যাদের রাজনৈতিক দুর্বলতা রয়েছে এবং মৌলবাদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে তারা তা লুকাতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করেন।
সূত্র- যুগান্তর