জ্বালানি সংকট : জরুরি ডলার সহায়তা চেয়েছে জ্বালানি বিভাগ

নিজস্ব প্রতিবেদক । ০৩ অক্টোবর ২০২৩

জ্বালানি সংকট : জরুরি ডলার সহায়তা চেয়েছে জ্বালানি বিভাগ

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কয়েক মাস ধরে জমে থাকা বকেয়া আমদানি বিল নিষ্পত্তির জন্য জরুরিভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা চেয়েছে জ্বালানি বিভাগ।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি নথি অনুযায়ী, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের কাছে বিপিসি-এর বকেয়া পেমেন্ট দাঁড়িয়েছে ৬৭০ মিলিয়ন ডলারে। যেখানে ২৬০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া আছে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের কাছে এবং ৪১০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া অন্যান্য সরবরাহকারীদের কাছে।

অথচ ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের কাছে বিপিসি'র বকেয়া ছিল মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দেড় মাসেই বকেয়া বেড়েছে আট গুণেরও বেশি।

এ অর্থ পরিশোধে আরো বিলম্ব হলে সরবরাহকারীদের জরিমানা আরোপ করার সম্ভাবনা থেকে যায়।

এই পরিস্থিতিতে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, সচিব, বিপিসি ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানসহ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বিষয়টি সমাধানের জন্য ২৮ সেপ্টেম্বর একটি জরুরি বৈঠক ডাকেন। উচ্চপর্যায়ের এ বৈঠকের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসের শুরুতে ডলার সংকটের কারণে বিপিসি আমদানি বিল পরিশোধ করতে হিমশিম খায়। সেসময় কিছু সরবরাহকারী পেমেন্ট পাওয়ার আগে চট্টগ্রাম বন্দরে তেল আনলোড করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর বিপিসি অর্থ পরিশোধ করলে একজন সরবরাহকারী বন্দরে তেল আনলোড করে। এরপর থেকে বিপিসি নিয়মিতভাবে আমদানি বিল পরিশোধের চেষ্টা করছে। কিন্তু ডলারের অভাবে আগস্টের মাঝামাঝিতে পরিস্থিতি আবার খারাপ হয়।

জ্বালানি বিভাগের সচিব মো. নূরুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "দেশে কি জ্বালানি তেলের কোনো সংকট আছে? তাহলে এসব কথা বলছেন কেন?

বিপিসি চেয়ারম্যান এবিএম আজাদের সাথে বেশ কয়েকবার ফোনকল ও মোবাইল বার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, অগ্রাধিকার আমদানিতে সহায়তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করে থাকে এবং ভবিষ্যতেও এই সহায়তা অব্যাহত থাকবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, করপোরেশনে টাকার অভাব নেই, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে তারা পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছে না।

ওই কর্মকর্তা বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের যা দিচ্ছে, তা অপর্যাপ্ত।"

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, আমদানি বিলের চাহিদা মেটাতে বিপিসি'র দৈনিক গড়ে ৩৫ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কিন্তু এ বছরের ২৫ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তারা প্রতিদিন ১৫ মিলিয়ন ডলার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে।

একসময় অনেক ব্যাংকের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিপিসি। এ করপোরেশন থেকে বেশ বড় অংকের এলসি খোলা হতো বিধায় ব্যাংকগুলোও বড় কমিশন পেত।

ফোলে চারটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ছাড়াও অন্যান্য বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংক যেমন ওয়ান ব্যাংক, ইবিএল, ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসি- এসব ব্যাংক তেল আমদানির জন্য বিপিসি'র এলসি খুলত।

কিন্তু এখনের চিত্র ভিন্ন। উপরোল্লিখিত স্থানীয় প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি ব্যাংক সর্বশেষ গত বছরের মার্চে বিপিসি'র জন্য এলসি খোলে। এরপর এ বছরের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার পাওয়ার পর আরেকটি ব্যাংক বিপিসি'র জন্য ৫ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলে।

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, ডলার সংকটের কারণে বিপিসি'র এলসি খুলতে বা সরবরাহকারীদের অর্থ পরিশোধে বিলম্ব হচ্ছে।

"বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ করে। বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে কিছু গ্যাপ দেখা দিয়েছে," বলেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, "আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে যাতে কোনো আতঙ্ক না থাকে সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যথেষ্ট সতর্ক।"

বর্তমানে চার মাসের বেশি সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় আমদানির সমপরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে। জায়েদ বখত বলেন, কিছু ক্ষেত্রে রিজার্ভ পরিস্থিতির কারণে এলসি খোলা পেছানো হচ্ছে।

আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের সরবরাহ বাড়াবে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বিপিসি প্রতি মাসে ৫ লাখ টন পরিশোধিত এবং ১ লাখ টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করে। এজন্য ১৭ থেকে ১৮টি এলসি খুলতে হয়। এর খরচ ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলার। ডলারের দাম বৃদ্ধিতে এখন প্রতি মাসে আরও ২৫% বেশি খরচ হচ্ছে তাদের।

যেসব প্রতিষ্ঠানকে বকেয়া পরিশোধ করতে হবে বিপিসি'র

বিপিসি মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান থেকে জ্বালানি তেল সংগ্রহ করে থাকে। এরমধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করে। বাকি আট প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করে পরিশোধিত জ্বালানি তেল।

বিপিসি'র এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সোমবার পর্যন্ত সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠান ভিটল এর বকেয়া দাঁড়িয়েছে ১১৬.৪৮ মিলিয়ন ডলার। চারটি এলসির পাওনা সময়মত পরিশোধ না হওয়ার কারণে এই পরিমাণ বকেয়া জমেছে।

এসব পাওনা ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিশোধ করার কথা ছিলো। এলসিগুলো খোলা হয়েছিল সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে।

আরেক সরবরাহকারী ইউনিপেক এর পাওনা ৩৩.৫৪ মিলিয়ন ডলার। সোনালী ব্যাংকে খোলা একটি এলসির বিপরীতে এই পরিমাণ পাওনা রয়েছে, যেটি গত ১১ সেপ্টেম্বর পরিশোধ করার কথা ছিল।

একইভাবে বিএসপি নামের সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ব্যাংকের একটি এলসির বিপরীতে ৩২.৩৩ মিলিয়ন ডলার পাবে। যা গত ৩০ আগস্ট পরিশোধের দিন ধার্য ছিলো।

একইভাবে পেট্রোবাংলাও আমদানি করা এলএনজির মূল্য সময়মত পরিশোধ করতে পারছে না। সরবরাহকারিদের কাছে তাদের বকেয়া দেনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার।

পেট্রোবাংলার কাছে টাকারও ঘাটতি রয়েছে বলে জানা গেছে। আশা করা হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তূকির টাকা ছাড় হলে পেট্রোবাংলার বকেয়া পরিশোধ করা সহজ হবে।

জ্বালানি তেলের চাহিদা ও আমদানি

বাংলাদেশ যত জ্বালানি তেল আমদানি করে তার ৭০% পরিশোধিত তেল। বাকিটা অপরিশোধিত। মোট জ্বালানি তেলের ৭০ ভাগ ডিজেল।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩২ লাখ ৬৫ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল কেনার পরিকল্পনা রয়েছে বিপিসির। এই সময়ে ৬ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিরও পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির।

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিপিসি পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে প্রায় ১৮ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করেছে।