বিজয় লক্ষী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

নিজস্ব প্রতিবেদক । ০৮ আগস্ট ২০২২

বিজয় লক্ষী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

কোন রনে কত খুন দিল নর,
লেখা আছে ইতিহাসে।
কত নারী দিল সিথীর সিদুর,
লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপারি,
কত বোন দিল সেবা।
বীরের স্মৃতির স্থম্ভের গায়ে,
লিখিয়া রাখিছে কে বা?
কোন কালে একা হয়নিকো জয়ী,
পুরুষের তরবারি।
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে,
বিজয় লক্ষী নারী।।
জাতিরপিতার ছায়াসঙ্গী থেকে যে নারী, জাতির পিতাকে সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, তিনি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

আজ ৮ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন। ১৯৩০ সালের এ দিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

তাঁর ডাক নাম ছিল ‘রেনু’। পিতার নাম শেখ জহুরুল হক ও মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। দাদা শেখ কাসেম চাচাত ভাই শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেগম ফজিলাতুন্নেছার বিয়ে দেন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা নেন। এরপর সামাজিক রীতি-নীতির কারণে গ্রামে গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেন।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে তার সহধর্মিনী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তাকে সাহস দিয়েছেন। পাশে থেকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ব্যস্ততা ও কারাজীবনে পরিবারের হাল ধরা, আত্মীয়-স্বজন ও সামাজিক পরিসরে যোগদান করা, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা, লেখাপড়ার সব দায়িত্বই তিনি নিজের হাতে নিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু কারাঅন্তরীণ হলে দলীয় নেতাকর্মীদের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে তাদের খোঁজখবর রাখতেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সন্তানদের গড়ে তোলেন।

রাজনৈতিক জীবনের অনেক জটিল সংকট পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে পরামর্শ দিতেন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করতেন তিনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করার পর তদানীন্তন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করে গ্রেফতারের হুমকি দেয়।

বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ স্বাধীকার আন্দোলনের প্রতি পদক্ষেপে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন তিনি। স্বামীর আদর্শ বাস্তবায়ন করবার জন্য ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় বছরের পর বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। তাঁর অবর্তমানে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করতে সহায়তা করা, আন্দোলন পরিচালনায় পরামর্শ দেওয়াসহ প্রতিটি কাজে তিনি যুক্ত থেকেছেন ফজিলাতুন্নেসা।

আন্দোলন চলাকালে তিনি প্রতিটি ঘটনা জেলখানায় সাক্ষাৎকারের সময় বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশ নিয়ে আসতেন, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সে নির্দেশ জানাতেন। নেপথ্যে থেকে তিনি ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ বাঁচিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হানাদার বাহিনীর চোখ এড়িয়ে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ জামাল, শেখ রাসেল প্রমুখ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে আত্মগোপন করেন। কিন্তু পাক বাহিনী ক্ষিপ্ত হায়েনার মতো তাঁদের খুঁজে বেড়ায়। কিছু দিন বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে পালিয়ে থাকলেও শেষাবধি পাকিন্তানি সামরিক গোয়েন্দারা তাদের মগবাজারের একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। এর পর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে পরিবারের অপরাপর সদস্যদের সঙ্গে ধানমন্ডির ১৮ নং সড়কের একটি বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।

মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় এবং পাক বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর তাদের বন্দিদশার অবসান ঘটে। এই মহীয়সী নারী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেশ ও জাতির সেবা করে গেছেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার সময় পরিবারের অপরাপর সদস্যদের সঙ্গে বেগম মুজিবকেও মানবতার শত্রু, ঘৃণ্য ঘাতক, দুশমনের দল নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী হিসেবে নয়, একজন নীরব দক্ষ সংগঠক হিসেবে যিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয় সমআসনে অধিষ্ঠিত করেছেন তিনি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

সেই মহীয়সী নারীর জন্মদিনে, উনাকে স্মরণ করছি অতল শ্রদ্ধায়।
লেখক - কৃষিবিদ দীপক কুমার বনিক দীপু।
সদস্য, কেন্দ্রীয় উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।