নিজস্ব প্রতিবেদক । ১৩ নভেম্বর ২০২২
রাজিবুল ইসলাম রক্তিম: বগুড়ায় কিশোর গ্যাং ও বার্মিজ চাকু ব্যবহার একটা সামাজিক মরন ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। একটি আরেকটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বর্তমানে বগুড়া জেলায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, জমিদখল, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, ধর্ষণ এবং খুন-খারাবি ইত্যাদি সংগঠিত হচ্ছে যার অধিকাংশ কিশোর সন্ত্রাসীরা জড়িত। অপরাধকর্ম ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার বা দলগত সেরা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া হিসাবে এইসব কিশোর সন্ত্রাসীরা পাড়ায় পাড়ায় প্রথমে ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি করে। ধীরে ধীরে ছোট গ্রুপ তৈরি হয় বিশাল বাহিনীর। অন্য দল বা অন্য এলাকার কিশোরদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে এইসব কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীরা রোমাঞ্চকর স্বাদ পেয়ে যায়। আর এই রোমাঞ্চকর স্বাদ থেকে শুরু হয় তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড। তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ডের কারণে মানুষ অস্বস্তিকর অশান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করছে।
বগুড়া শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও এলাকাবাসী নির্যাতনের শিকার হওয়া অনেকই জানান, আমরা সবসময় এইসব কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের ভয়ে নিজেদের সহায়-সম্পদ, উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটায়। কখন কারা জায়গা-জমি দখল করতে আসে বা চাঁদা দাবি করতে আসে, স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েটিকে কখন কোন বখাটে বিরক্ত করে বা স্কুলে যাওয়া ছেলেটিকে তাদের দলে ভিড়িয়ে ফেলে। সমাজের নিরীহ অংশ বিশেষ করে যাদের কোনো প্রভাব প্রতিপত্তি নেই বা প্রভাবশালী মহলের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক ও যোগাযোগ নেই তাদের আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি।
এলাকাবাসী আরও জানান, অনেক সময় আমরা এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা কামনা করলে গ্যাং এর সদস্যরা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। কোন কোন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে আসার আগে এসব গ্যাং সদস্যরা সেখান থেকে সড়িয়ে পরে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন ইসলাম তুহিন জানান, বগুড়ায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম ও বার্মিজ চাকু ব্যবহার একটা সামাজিক মরন ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এই কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি বর্তমানে তরুণদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে যার মূল কারণ হলো সামাজিকভাবে দায়বদ্ধতার অভাব। পারিবারিক দায়বদ্ধতার অভাব, সঠিক শিক্ষা ও শিষ্টাচারের অভাব, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবের পথভ্রষ্ট হয়ে তরুণরা কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে। নিজেদেরকে হিরোইজম বা বাহাদুরি, বাবার অবৈধ আয়ের কাঁচা টাকা-পয়সা, মাদকাসক্তি, সাংস্কৃতিক চর্চার নামে সস্তা ছেলে-মেয়েদের অবাধে মেলামেশার ফলে সমাজের ভেতরে ভেতরে উইপোকার মতো বিস্তার লাভ করছে কিশোর গ্যাং ও তাদের অপরাধ। এসব গ্যাংয়ের উৎপাতে পাড়ায় পাড়ায় মারামারি হানাহানি লেগেই আছে।
তিনি আরও জানান,অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে খেলাধুলা করার কোন মাঠ নাই। পুকুর, নদী-নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা বা পুকুর-নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি করার সুযোগ নিঃশেষ হয়ে গেছে। এই সব থেকে বঞ্চিত হয়ে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে গিয়েই গ্যাং সৃষ্টি করেছে। আগে অঞ্চলভিত্তিক, পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন টুর্নামেন্ট ও খেলাধুলার প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো, যাতে সবার মধ্যে সৌহার্দ্যরে বন্ধন এবং সুস্থ প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হতো। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের সাথে নিয়ে সমাজে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং রোধে কাজ করবে। যাতে সামাজিক ভাবে দায়বদ্ধতা থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে স্কুল পড়ুয়া বাচ্চারা যাতে কোনোভাবেই রাজনীতির সাথে জড়িয়ে না পড়ে। তারা কোথায় যাচ্ছে কার সাথে মিশতেছে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
এই বিষয়ে জেলা পুলিশের মিডিয়া ও মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শরাফত ইসলাম জানান, কিশোর গ্যাং এবং কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম ও তাদের দ্বারা সৃষ্ট অপরাধসমূহ নির্মূলের জন্য জেলা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তবে কিশোর গ্যাং নির্মূল করতে মূখ্য ভূমিকা পালনের জন্য পরিবারের লোকজন হতে পারে অন্যতম মাধ্যম। পরিবার থেকেই তাদের বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। পুলিশের একার পক্ষে অপরাধ কর্মকাণ্ড দমন করা সম্ভব নয় তাই সামাজিক ভাবে দায়বদ্ধতা থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।