নিজস্ব প্রতিবেদক । ১৪ জুন ২০২২
কয়েক সপ্তাহ আগে তাইওয়ানের বিষয়ে চীনকে সতর্ক করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এরপর বেইজিং এ যাবৎকালের সবচেয়ে কড়া ভাষায় তার প্রতিবাদ করে। চীন বলছে, তাইওয়ানের স্বাধীনতার ‘যেকোনো প্রচেষ্টা দৃঢ়তার সঙ্গে চুরমার করে দেবে’ দেশটি। দুই পক্ষের এই কথার লড়াই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে গড়াবে কি না, তা নিয়ে একটি ধারণা দিতে চেয়েছে বিবিসি।
দ্বীপটির স্বাধীনতা অর্জনে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিচ্ছে বলে গত রোববার চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গহি জোরালো অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘তাইওয়ান ইস্যুতে নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে’ এবং চীনের বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’ করছে।
সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এশীয় নিরাপত্তা সম্মেলন শাংরি-লা ডায়ালগ-এ চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমাকে বিষয়টি স্পষ্ট করতে দিন—কেউ যদি তাইওয়ানকে চীন থেকে আলাদা করতে চায়, আমরা যুদ্ধ করতে দ্বিধা করব না। আমরা সবকিছুর বিনিময়ে লড়ব। আমরা একেবারে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব। চীনের সামনে একমাত্র এই পথই খোলা।
এর আগে চীনকে উদ্দেশ্য করে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, তাইওয়ানের কাছে যুদ্ধবিমান উড়িয়ে ‘বিপদ নিয়ে খেলছে’ চীন। আক্রান্ত হলে সামরিকভাবে দ্বীপটিকে রক্ষা করারও অঙ্গীকার করেন তিনি।
তাইওয়ান নিজেদের সার্বভৌম জাতি হিসেবে মনে করে। তবে দ্বীপটিকে নিজের অংশ বলেই দাবি করে আসছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের সবচেয়ে বড় মিত্র মনে করে তাইওয়ান। দ্বীপটির আত্মরক্ষায় সহযোগিতা প্রদান নিয়ে ওয়াশিংটনের একটি আইনও রয়েছে।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় এই কথার লড়াই শুরু হয়েছে। তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা অঞ্চলে যুদ্ধবিমান পাঠানো বাড়িয়েছে চীন। গত মাসে চলতি বছরের সবচেয়ে বড় যুদ্ধবিমান বহরটি পাঠিয়েছিল দেশটি। এদিকে তাইওয়ানের জলসীমায় নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
চীন তাইওয়ানে আগ্রাসন চালালে যুদ্ধ শুরু হবে এটাই বড় দুশ্চিন্তা। অতীতে বেইজিং বলেছে, প্রয়োজনে দেশটি শক্তি প্রয়োগ করে দ্বীপটি দখলে নেবে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখনই তেমন কিছু হচ্ছে না।
তাইওয়ানে আগ্রাসন চালিয়ে সফল হওয়ার মতো সামরিক সামর্থ্য চীনের আছে কি না, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নিজেদের আকাশ ও সমুদ্র প্রতিরক্ষা তাইওয়ান লক্ষণীয়ভাবে বাড়িয়ে চলেছে।
অবশ্য অনেকেই এ বিষয়ে একমত, তাইওয়ানে আগ্রাসন চালানোর মতো পদক্ষেপের মূল্য যে অনেক চড়া এবং ধ্বংসাত্মক হবে, বেইজিং তা স্বীকার করে নিয়েছে। আর তা কেবল চীনের জন্যই নয়, বরং গোটা বিশ্বের জন্যও।
ইনস্টিটিউট অব সাউথইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো উইলিয়াম চুং বলেন, অনেক কথার লড়াই হচ্ছে। তবে তাইওয়ানে আগ্রাসন চালাতে চাইলে চীনকে খুব খেয়াল করে ব্যবধানটা মাথায় রাখতে হবে, বিশেষ করে, বিষয়টা খুব বেশি ইউক্রেন সংকটের মতো হওয়ায়। চীনের অর্থনীতি রাশিয়ার চেয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে অনেক বেশি যুক্ত।
তাইওয়ানের সঙ্গে ‘শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলন’ চায় চীন। এ অবস্থানের ধারাবাহিকতার বিষয়টিই রোববার পুনর্ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। বলতে চেয়েছেন, উসকানিমূলক আচরণ করলেই কেবল ব্যবস্থা নেবে দেশটি।
এই কাজটি হতে পারে যদি তাইওয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তবে বিষয়টি কঠোরভাবে এড়িয়ে গেছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন। যদিও তিনি জোর দিয়ে বলেন, তারা ইতিমধ্যেই একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র।
তাইওয়ানের অধিকাংশ নাগরিকই এই অবস্থান সমর্থন করে। এটা ‘স্থিতাবস্থা বজায় রাখা’ হিসেবে পরিচিত। যদিও ছোট একটি অংশ ক্রমাগত বলছে, তারা স্বাধীনতার দিকে এগোতে চায়।
একইভাবে, এশিয়ায় চড়া মূল্যের একটি সামরিক সংঘাত জড়িয়ে পড়তে যুক্তরাষ্ট্রও অনিচ্ছুক হবে। দেশটি বারবার ইঙ্গিত দিচ্ছে, তারা যুদ্ধ চায় না।
সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সংলাপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনও অংশ নেন। তিনি বলেন, তাইওয়ানের স্বাধীনতা সমর্থন করে না যুক্তরাষ্ট্র, দেশটি ‘নতুন একটি স্নায়ুযুদ্ধ’ চায় না।
সিঙ্গাপুরে নিরাপত্তা সম্মেলনের সাইডলাইনে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ও চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেঙ্গহির বৈঠক
সিঙ্গাপুরে নিরাপত্তা সম্মেলনের সাইডলাইনে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ও চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেঙ্গহির বৈঠক ছবি: টুইটার
এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো কলিন কোহ বলেন, তাইওয়ান ইস্যুতে উভয় পক্ষই তাঁদের প্রতিশ্রুতির বিষয়ে অটল। এ বিষয়ে তাদের শক্ত অবস্থান দেখাতে হবে, যাতে মনে না হয় তারা সরে যাচ্ছে কিংবা পিছু হটছে।
কলিন কোহ বলেন, অবশ্য একই সময়ে পুরোপুরি একটি সংঘাতে পা বাড়ানোর বিষয়েও তারা খুবই সজাগ। তারা খুব ভালোভাবেই পরস্পরের কথার লড়াইয়ের ওপর নজর রাখছে। দুই পক্ষই ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করছে।
কলিন কোহ বলেন, বাস্তবতা হলো—শাংরি-লা ডায়ালগ সম্মেলনের সাইডলাইনে ওয়েই ও অস্টিন বৈঠক করেছেন, যা ইতিবাচক লক্ষণ। এর মানে হলো—দুই পক্ষই দেখাতে চায় ‘তারা এখনো বসতে ও কথা বলতে, ঐকমত্যে আসতে এবং দ্বিমত থাকা বিষয়গুলো নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে ইচ্ছুক।
কলিন কোহ আরও বলেন, এ ধরনের বৈঠকের ফলে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে কার্যকর আলোচনার পথ উন্মুক্ত হতে পারে। বাস্তবে পরস্পরের শক্তিমত্তা নিয়ে যে ভুল ধারণা সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে, এ ধরনের আলোচনা সেই আশঙ্কা কমাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ‘সংলাপের সার্বিক পুনরুজ্জীবনের’ বিষয়টি অনুপস্থিত ছিল।
চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অদূর ভবিষ্যতেও তাদের কথার লড়াই অব্যাহত রাখবে বলেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের চীন বিশেষজ্ঞ ইয়ান চং বলেন, তাইওয়ানের সামরিক বাহিনীকে হতোদ্যম করে দিতে ও ধৈর্য পরীক্ষায় চীন তার জবরদস্তিমূলক কর্মকাণ্ড আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে আরও যুদ্ধবিমান পাঠানো কিংবা বিভ্রান্তমূলক প্রচারণার কাজটি করতে পারে।
দ্বীপটির নির্বাচনের আগে চীন বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালিয়েছে বলে অতীতে অভিযোগ করেছে তাইওয়ান। চলতি বছরের শেষ নাগাদ দ্বীপটিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
ইয়ান চং বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো দিক হলো কোনো পক্ষই উত্তেজনা বাড়াতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু উত্তেজনা না বাড়ানোর মানে এই নয় যে আমরা একটি ভালো অবস্থানের দিকে যাচ্ছি। তাই কিছু সময়ের জন্য আমরা এই অবস্থার মধ্যেই আটকে থাকছি।’