নিজস্ব প্রতিবেদক । ১৪ নভেম্বর ২০২৩
বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি কোনো একটি রাজনৈতিক দলের বিপরীতে অন্য রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না-এমন মন্তব্য করে দেশটি বিবদমান সব পক্ষকে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানায়।
সোমবার আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র চিঠিতে এসব কথা বলা হয়। যদিও সোমবার রাত সাড়ে নয়টায় আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, ‘আমরা এমন চিঠি পাইনি।’ তবে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, ‘আমরা চিঠি পেয়েছি’। আর সোমবার বিকালে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপির কাছে ওই চিঠি পৌঁছে দেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র বলেছেন, রাষ্ট্রদূত (পিটার) হাস আসন্ন নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অনুধাবনের লক্ষ্যে বৈঠকে বসার জন্য তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। তারা সব পক্ষকে সহিংসতা পরিহার এবং সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানায়।
ওই চিঠিতে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণা করা ভিসানীতির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, যারা গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ভিসানীতি (থ্রিসি) প্রয়োগ করা হবে।
ডোনাল্ড লু তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে কোনো চিঠি পাঠিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র বলেন, প্রাইভেট কোনো কূটনৈতিক যোগাযোগের বিষয়ে মন্তব্য না করা আমাদের দীর্ঘদিনের চর্চা।
সম্প্রতি দিল্লিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ২+২ সংলাপের পর তিন দলকে এই চিঠি দিলেন ডোনাল্ড লু। যদিও সংলাপ শেষে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা সাংবাদিকদের বলেছেন, আলোচনায় বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়টি স্থান পেয়েছে।
এ ব্যাপারে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করেছে দেশটি। ভারত মনে করে, এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরা পর্দার আড়ালে তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এছাড়া প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন কূটনীতিকরা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠকের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাংবাদিকদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র শর্তহীন সংলাপ দেখতে চায়। তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের সঙ্গে বৈঠক করেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক। সংলাপ প্রশ্নে তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, সংলাপ হতে হবে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে। বিএনপি নেতা আব্দুল মঈন খান ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন কুক।
জানা গেছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার উদ্যোগের অংশ হিসাবে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস সোমবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদেরের সঙ্গে দেখা করেন। জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে প্রায় ৪০ মিনিটের এই সাক্ষাৎপর্বে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এ সময় তাদের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু লিখিত একটা চিঠি জিএম কাদেরের কাছে হস্তান্তর করেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে জাতীয় পার্টি মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এমপি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত তাদের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু লিখিত একটা চিঠি নিয়ে এসেছেন। তিনি চিঠিটা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের কাছে হস্তান্তর করেন। একই চিঠি বাংলাদেশের তিনটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সেই চিঠির বিষয়ে সংক্ষেপে বলা যায়, বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়।
মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে দেওয়া ডোনাল্ড লু’র চিঠিটি উপস্থিত দলের নেতাদের পড়ে শুনিয়েছেন। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জাতীয় পার্টি কী জানিয়েছে-গণমাধ্যমকর্মীদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা তো আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাদের কেন জানাব? বাংলাদেশের জনগণের দাবি একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। আমাদেরও একই দাবি।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সাবেক মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান এমপি এ প্রসঙ্গে সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের চিঠির কথা আমার জানা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিবদমান সব পক্ষকে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান সম্পর্কে তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধের নামে সংঘাত-সহিংসতার পথ বেছে নিয়ে বিএনপি আলোচনার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। ফারুক খান বলেন, বিএনপি প্রথম থেকেই নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত করতে চায়। তারা জ্বালাও-পোড়াও অগ্নিসংযোগসহ মানুষ হত্যার পথ বেছে নিয়ে অশুভ শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে চায়। তাই তাদের সঙ্গে বসে কোনো লাভ নেই।
অন্যদিকে মাঠের বিরোধী দল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, প্রবীণ রাজনীতিবিদ নজরুল ইসলাম খান এ প্রসঙ্গে সোমবার যুগান্তরকে বলেন, চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমি এখন পর্যন্ত কিছু জানি না। চিঠি না দেখে, চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে না জেনে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছি। এই দাবি সরকার মেনে নিলে তাদের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। এর বাইরে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই।
প্রসঙ্গত, সংবিধান অনুযায়ী সংসদের ৫ বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বর্তমান সংসদের মেয়াদ ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি শেষ হবে। এক্ষেত্রে ৯০ দিনের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে।