নিজস্ব প্রতিবেদক । ১৫ জুলাই ২০২৩
ভারতের জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্রশিল্প বলিউডকে প্রায়ই ‘পুরুষের জগৎ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছে। তবে নতুন এক গবেষণায় বলিউডে পর্দা ও পর্দার বাইরে লিঙ্গসমতার করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
২১০ কোটি মার্কিন ডলারের চলচ্চিত্রশিল্প বলিউডে প্রতিবছর শত শত সিনেমা মুক্তি পায়। বিশ্বব্যাপী এসব সিনেমার প্রচুর দর্শক রয়েছেন।
দর্শক-ভক্তদের চিন্তাভাবনা-কল্পনার ওপর সিনেমা ও চলচ্চিত্র তারকারা যে প্রভাব ফেলছেন, তা জোরের সঙ্গেই বলা যায়।
কিন্তু পশ্চাৎগামিতা, কুসংস্কার প্রচার ও লিঙ্গবৈষম্যের জন্য বছরের পর বছর ধরে বলিউডের অনেক সিনেমার সমালোচনা হচ্ছে।
ভারতের মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের (টিস) গবেষকেরা হিন্দি সিনেমায় পিতৃতন্ত্রের দাপট কতটা প্রকট, তা পরিমাপের চেষ্টা করেছেন। বলিউড নিয়ে এই প্রথম এ ধরনের গবেষণা হলো।
গবেষকেরা তাঁদের গবেষণার জন্য ২০১৯ সালের বক্স-অফিস হিট হওয়া সিনেমাগুলোর মধ্য থেকে ২৫টি বাছাই করেন।
এ ছাড়া ২০১২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যকার ১০টি নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র গবেষকেরা বেছে নিয়েছিলেন। ২০১২ ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে একটি বাসে এক ছাত্রী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। এ নিয়ে তখন ব্যাপক বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়। এর জেরে ভারত সরকার নারীর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন-সংক্রান্ত কঠোর আইন প্রবর্তন করে। এই ঘটনার পর বলিউডের সিনেমার গল্পে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না, তা দেখতে চেয়েছিলেন গবেষকেরা।
গবেষণার জন্য বাছাই করা বক্স-অফিস হিট সিনেমাগুলোর মধ্যে ছিল ‘ওয়ার’, ‘কবির সিং’, ‘মিশন মঙ্গল’, ‘দাবাং ৩ ’, ‘হাউসফুল ৪ ’, ‘আর্টিকেল ১৫ ’।
আর নারীকেন্দ্রিক সিনেমাগুলোর মধ্যে ছিল ‘রাজি’, ‘কুইন’, ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বোরখা’, ‘মার্গারিটা উইথ আ স্ট্র’ ইত্যাদি।
গবেষকেরা বাছাই করা সিনেমাগুলোর প্রায় দুই হাজার চরিত্র বিশ্লেষণ করেন। সিনেমায় চরিত্রগুলোর পেশার ধরন বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকেরা। এ ছাড়া তাঁরা যৌনতা-সংক্রান্ত গৎবাঁধা ধারণা, ঘনিষ্ঠতা, হয়রানির মতো বিভিন্ন বিষয়ের আলোকে সিনেমাগুলো বিশ্লেষণ করেছেন।
গবেষকেরা সিনেমাগুলোতে অংশ নেওয়া এলজিবিটিকিউ প্লাস ও প্রতিবন্ধী চরিত্রের সংখ্যা গুনে দেখেছেন। সিনেমায় তাঁদের চরিত্র কীভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে, তা তাঁরা দেখেছেন।
সিনেমাগুলোতে কতজন নারী পর্দার পেছনে কাজ করেছেন, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখেন গবেষকেরা।
গবেষকেরা এই উপসংহারে পৌঁছান, নারীকেন্দ্রিক সিনেমাগুলো কিছুটা আশাবাদ তৈরি করে। কিন্তু বক্স-অফিস হিট হওয়া সিনেমাগুলো যৌনতাবাদী ও পশ্চাদ্গামী। এসব সিনেমায় নারী, এলজিবিটিকিউ প্লাস, প্রতিবন্ধীদের প্রতিনিধিত্ব শোচনীয়।
যেমন গবেষণায় বিশ্লেষণ করা সিনেমাগুলোর চরিত্রের ৭২ শতাংশই পুরুষ। ২৬ শতাংশ নারী। ২ শতাংশ অন্যরা।
গবেষণা প্রকল্পটির প্রধান অধ্যাপক লক্ষ্মী লিঙ্গম বলেন, বলিউডের সব বড় বড় পুরুষ চরিত্রের ওপর ভর করে বড় অঙ্কের আয় আসছে। আর চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলছেন, খুব শক্তিশালী নারী চরিত্র দর্শকদের সঙ্গে যায় না।
লক্ষ্মী বিবিসিকে বলেন, বলিউডে ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা খুব কমই হয়েছে। কারণ, পুরুষতান্ত্রিকতা সিনেমার গল্পের ধারণা ও বর্ণনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। নির্মাতাদের মধ্যে এমন বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে এই ধরনের গল্পই দর্শক টানতে পারে, অর্থ আনতে পারে। তাই তারা এই সূত্রের মধ্যেই থাকেন।
লক্ষ্মী আরও বলেন, সিনেমায় নায়ককে উচ্চবর্ণের পুরুষ হতে হবে। প্রধান নারী চরিত্রকে হতে হবে হালকা-পাতলা, সুন্দরী। তাঁকে হতে হবে নম্র, বিনয়ী, যিনি কথার চেয়ে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সম্মতিসূচক ভাব প্রকাশ করেন। যৌনতা প্রকাশ করে—এমন পোশাক পরেন তিনি।
পর্দায় চরিত্রগুলো যে ভূমিকা পালন করে, তাতে একটি সংকীর্ণ লিঙ্গগত দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন লক্ষ্মী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সিনেমাগুলোতে অভিনয় করা প্রধান নারী চরিত্রের ৪২ শতাংশ ছিলেন চাকরিজীবী, যা বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু সিনেমায় এই নারী চরিত্রগুলোর পেশা ছিল খুব গৎবাঁধা ধরনের।
লক্ষ্মী বলেন, ১০ জনের মধ্যে ৯ জন পুরুষ চরিত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণমূলক ভূমিকায় ছিলেন। এই চরিত্রগুলো ছিল সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ, রাজনীতিবিদ ও গডফাদার। অন্যদিকে, নারী চরিত্রের বেশির ভাগই চিকিৎসক, নার্স, শিক্ষক ও সাংবাদিকদের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। ১০ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন নারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভূমিকায় ছিলেন।
গবেষণায় এলজিবিটিকিউ প্লাস চরিত্রগুলোর চিত্রায়ণে বড় ধরনের সমস্যা দেখা গেছে। তারা কখনোই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভূমিকায় ছিল না। চরিত্রকে প্রায়ই যৌনতাপূর্ণ রসিকতায় যুক্ত থাকতে দেখা গেছে। প্রতিবন্ধী চরিত্রের উপস্থিতি ও চিত্রায়ণও ভালো ছিল না।
লক্ষ্মী বলেন, চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলছেন, তাঁরা পর্দায় যা দেখাচ্ছেন, সেটিই বাস্তবতা। কিন্তু আরও অনেক বাস্তবতা রয়েছে, যা তাঁরা দেখান না।