নিজস্ব প্রতিবেদক । ১৮ জানুয়ারি ২০২৩
কিউ, এম, সাঈদ টিটো, নওগাঁ :
প্রধানমন্ত্রীর ফসলী জমি রক্ষার তাগিদ উপেক্ষা করে সবরকম নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে একশ্রেণির মুনাফাখোর মাটিখেকো নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ফসলী জমির উপরিভভাগের উর্বর মাটি টপ সয়েল অবৈধ ভেকু মেশিন দিয়ে কেটে এবং ফসলী জমি কেটে নতুন নতুন পুকুর খনন করছে। সেসব মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইটভাটায়। ফলে একদিকে যেমন আমাদের ফসলী জমি কমছে, তেমনি অবৈধ ইটভাটায় পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। অবিলম্বে এই মাটি কাটা বন্ধ করা না হলে ফসলী জমি কমতে থাকায় এলাকায় একদিন খাদ্যাভাব দেখা দিবে এবং জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়বে। এটা এই উপজেলার সাধারণ জনতার অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হবে। এটা জেনেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন একেবারেই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। স্থানীয়রা প্রতিদিন মোবাইলফোনে এবং লিখিতভাবে এসব মাটিখেকোদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করলেও এগুলো বন্ধের তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দুএকটি পুকুর খনন সাময়িক বন্ধ হলেও সংশ্লিষ্ট সকলকে ম্যানেজ করে কেউবা রাতের আঁধারে আবার কেউবা প্রকাশ্য দিবালোকেই আবার চালিয়ে যাচ্ছে এই অপকর্ম। ফলে এই এলাকায় এসব ফসলী জমির টপ সয়েল কাটা, পুকুর খনন, পুরাতন পুকুরের মাটি তুলে বিক্রি করা এখন ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে।
উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বিদ্যমান আইন অমান্য করে ফসলী জমির মাটি কেটে জমির ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণী পরিবর্তন করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন অনুমতি না নিয়েই। এসব কাজের মূল হোতা একশ্রেণীর ভেকু মেশিন ও ট্রাক্টর ব্যবসায়ী এবং ইটভাটার মালিক। এই উপজেলার প্রতিটি ইটভাটা মালিকের অসংখ্য ভেকু মেশিন ও ট্রাক্টর রয়েছে। এছাড়া কিছু মৌসুমী ব্যবসায়ীও ভেকু মেশিন ও ট্রাক্টর কিনে ব্যবসায় করে আসছেন। এসব ট্রাক্টর ও ভেকু মেশিন কৃষি কাজে ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও তারা নিয়ম ভেঙ্গে অবৈধ মাটি কাটার কাজে ভেকু মেশিন ব্যবহার করছে এবং সেই মাটি পরিবহণের জন্য ট্রাক্টর ব্যবহার করছে। ট্রাক্টরে করে মাটি পরিবহণের ফলে একদিকে যেমন গ্রামীণ কাঁচা রাস্তাগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে, তেমনি পাকা সড়ক ও হাইওয়েতে মাটি পড়ে গিয়ে সেই মাটি সড়কে জমা হয়ে থাকছে। সামান্য বৃষ্টি বা অন্য কোনভাবে সেই মাটিতে পানি পড়লে সড়ক কাদায় সয়লাব হয়ে পিচ্ছিল হয়ে পড়ছে। পিচ্ছিল কাদায় পড়ে অসংখ্য মোটরসাইকেল চালক দূর্ঘটনায় হতাহত হয়েছেন। ট্রাক্টরে মাটি পরিবহণের সময় ধূলায় গ্রামগঞ্জ ছেয়ে যায়। ফলে এলাকার অসংখ্য মানুষ শ্বাসকষ্টে ভূগছেন।
এলাকার ইটভাটা মালিক, ভেকু মেশিন মালিক ও ট্রাক্টর ব্যবসায়ীদের নিয়োগ করা লোকেরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ফসলী জমির মালিকদের নানা প্রলোভন দিয়ে তাদের জমিতে পুকুর খননে উদ্বুদ্ধ করছে। তারা সেসব মাটি কিনে ইটভাটায় নিয়ে যাচ্ছে। নদীর বালু দিয়ে ইট তৈরীর বিধান থাকলেও তারা সে নিয়ম ভেঙ্গে ফসলী জমির মাটি দিয়ে ইট তৈরী করছে। এছাড়া তিন ফসলী জমির টপ সয়েল কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এতে ফসলী জমি উর্বরতা হারাচ্ছে।
এসব অবৈধ পুকুর খনন, ফসলী জমির টপ সয়েল কাটা, ভেকু মেশিন দিয়ে ফসলী জমির মাটি কাটা, ট্রাক্টর দিয়ে মাটি পরিবহণ বন্ধ করা, এর সাথে জড়িতদের এবং ইতিমধ্যেই যারা অবৈধভাবে পুকুর খনন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। গতবছর এই উপজেলায় ৫০টিরও বেশী ফসলী জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে।
সরেজমিনে উপজেলার চাঁন্দাশ ইউনিয়নের বাগডোব এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ইউসুফ আলীর ইটের ভাটা সংলগ্ন জমি থেকে ভেকু মেশিন দিয়ে তিন ফুট গর্ত করে তিন ফসলী জমির উপরের উর্বর মাটি কেটে ট্রাক্টরে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইটভাটায়। সেখানে পাহাড় সমান স্তুপ করে রাখা হয়েছে ধানের লারাসহ মাটি। ওই এলাকার বেলাল হোসেন ও জাইদুর রহমান ভেকু মেশিন ভাড়া করে এনে এসব মাটি কাটছেন। এছাড়া খাজুর ইউনিয়নের রনাইল হাড়িপকড়া গ্রামে মেছের আলীর ছেলে হারেজ উদ্দিন, দেবীপুর আদ্যাবাড়ি গ্রামের ওসমান আলীর ছেলে আইনাল হোসেন, তছির মাস্টার, ডাঙ্গা গ্রামের ফয়েজ মন্ডলের ছেলে হাজী সাইফুল ইসলাম পুকুরের মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করছেন। ভাটা মালিক ইব্রাহীম সরকারের ভেকু মেশিন দিয়ে এসব মাটি কাটা হচ্ছে। চেরাগপুর ইউনিয়নের সরিজপুর এলাকায় মৃত মনির ফকিরের ছেলে মোহাম্মদ আলী পুকুরের মাটি কেটে বিক্রি করছেন। ভেকু মেশিন লাগিয়েছেন নওগাঁ শহরের ইদুর বটতলী মহল্লার তরিকুল ইসলাম সজিব। চৌমাশিয়া হিন্দুপাড়া সরকার পাড়ায় পুকুর কেটে মাটি ও বালি বিক্রি করছেন শ্রী কুমুদ সরদারের ছেলে সুকুমার সরদার। মাটি ও বালি কিনে নিয়ে অন্যত্র বিক্রি করছেন ওই এলাকার সিরাজ উদ্দিন। এই ইউনিয়নের বড় মহেশপুর মাঠে ফসলী জমি কেটে বিশাল পুকুর খনন করছেন ধনজইল মোড়ের হাজী মোকলেছুর রহমান। ভেকু মেশিন লাগিয়েছেন মহাদেবপুরের লিটন।
স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে নওগাঁ জেলা প্রশাসনের নির্দেশে স্থানীয় ভূমি কর্মকর্তা এটির খনন কাজ বন্ধ করে দেন। কিন্তু রাতের আঁধারে এটি আবার খনন করা হচ্ছে। এছাড়া কুঞ্জবন গ্রামের মৃত ফজলুর রহমানের ছেলে ভাটামালিক মো: আলম ভেকু মেশিন দিয়ে একাধিক পুকুর খনন করছেন।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু হাসান জানান, এলাকায় কোন পুকুর খননের অনুমতি দেয়া হয়নি। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া মাটি পরিবহণ করে রাস্তা পিচ্ছিল করার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।#