নিজস্ব প্রতিবেদক । ১৭ আগস্ট ২০২২
যারা খুনিদের আশ্রয় দেয়, তারাই মানবতার সবক শেখায় বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমার বাবা-মা ও ভাইদের যারা হত্যা করেছে সেই খুনিদের আশ্রয় দিয়ে রেখেছে আজ মানবাধিকারের কথা বলা বড় বড় দেশগুলো।
মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আজ চারদিক থেকে মানবাধিকারের প্রশ্ন আসে। মানবাধিকারের কথা বলা হয়। আমাদের সরকারকে মানবাধিকারের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়। যারা এই প্রশ্ন করে তাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, আমাদের মানবাধিকার, ১৫ আগস্ট আমরা যারা আপনজন হারিয়েছি তাদের মানবাধিকার কোথায় ছিল? আমাদের তো বিচার চাওয়ার অধিকার ছিল না। আমরা বাবা-মা হারিয়েছি। আমরা মামলা করতে পারব না। বিচার চাইতে পারব না। কেন? আমরা দেশের নাগরিক না? আমি, আমার ছোট বোন বিদেশে ছিলাম। বেঁচে গিয়েছিলাম ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাত থেকে। এই বাঁচা কত যন্ত্রণার বাঁচা, যারা বাঁচে তারা জানে।
তিনি বলেন, আমাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছিলো। ৯৬ সালে যদি সরকারে আসতে না পারতাম, যদি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করতে না পারতাম, এই হত্যার বিচার কোনো দিন হতো না। বারবার বাধা এসেছে। এমনকি বক্তৃতা দিয়ে বিচার চাইতে গিয়েও বাধা পেয়েছি। যে এই কথা বললে নাকি কোনো দিন ক্ষমতায় যেতে পারব না। এ রকম কথাও আমাকে শুনতে হয়েছে। আমি বাধা মানিনি। আমি দাবিতে সোচ্চার হয়েছি। দেশে-বিদেশে জনমত সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছি।
সরকার প্রধান বলেন, সর্ব প্রথম এই হত্যার প্রতিবাদ করে বক্তব্য দিয়েছে রেহানা। ৭৯ সালে সুইডেনে। এরপর আমি ৮০ সালে বিদেশে গেছি। একটা কমিশন গঠন করেছি, চেষ্টা করেছি আন্তর্জাতিকভাবে। তখন তো দেশে আসতে পারিনি, আমাকে আসতে দেওয়া হবে না। ৮১ সালে দেশে আসার পর জনমত সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছি। অপপ্রচার চালানো হয়েছে আমার বাবার নামে, ভাইয়ের নামে, মায়ের নামে- মিথ্যা অপপ্রচার। কোথায় সেগুলো? কত রকমের মিথ্যা অপপ্রচার দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। তারপরও যখন দেখে যে না বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে জাতির পিতার নাম মুছে ফেলা যায় না।
তিনি বলেন, ১৫ আগস্ট, ৩২ নম্বরে লাশগুলো তো পড়ে ছিল। কত স্লোগান, বঙ্গবন্ধু তুমি আছো যেখানে, আমরা সেখানে। অনেক স্লোগানই তো ছিল। কোথায় ছিল সেই মানুষগুলো? একটি মানুষও ছিল না সাহস করে এগিয়ে আসার? একটি মানুষও ছিল না প্রতিবাদ করার? কেন করতে পারেনি? এত বড় সংগঠন, এত সমর্থক, এত লোক। কেউ তো একটা কথাও বলার সাহস পায়নি। ১৫ আগস্ট থেকে ১৬ আগস্ট ওই লাশগুলো পড়ে ছিল। ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে গেল টুঙ্গিপাড়া। কারণ দুর্গম পথ। ২২ থেকে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে, কেউ যেতে পারবে না। তাই সেখানে নিয়ে মা-বাবার কবরের পাশে মাটি দিয়ে আসে। সেখানকার মৌলভী সাহেব আপত্তি করেছিল যে গোসল দেব, কাফন-দাফন…।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছু নিয়ে যাননি (বঙ্গবন্ধু), শুধু দিয়ে গেছেন। একটা দেশ দিয়ে গেছেন; একটা জাতি দিয়ে গেছেন; পরিচয় দিয়ে গেছেন; আত্মপরিচয় দিয়ে গেছেন। কিছুই নিয়ে যাননি বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে। বাংলাদেশের গরিব মানুষকে যে রিলিফের কাপড় তিনি দিতে পারতেন সেই রিলিফের কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে সে কাপড় দিয়ে তাকে কাফন দেওয়া হয়েছিল। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে কিছুই নিয়ে যায়নি। ওই ১৬ তারিখে সমস্ত লাশ নিয়ে বনানীতে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল।
তিনি বলেন, মুসলমান হিসেবে যে দাবি থাকে জানাজা পড়ার সেটাও তো পড়েনি। একটু কাফনের কাপড়, সেটাও দেয়নি। পঁচাত্তরের ঘাতকরা হত্যার পর বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু ইসলামিক কোনো বিধি তারা মানেনি। আমার একটা প্রশ্ন, আমাদের নেতারাও তো এখানে আছেন। জাতির পিতা তো অনেককে ফোনও করেছিলেন। কী করেছিলেন তারা? বেঁচে থাকতে সবাই থাকে। মরে গেলে যে কেউ থাকে না তার জীবন্ত প্রমাণ এটা। এ জন্য আমি কিছু আশা করি না। সব সহ্য করে নীলকণ্ঠ হয়ে শুধু অপেক্ষা করেছি কবে ক্ষমতায় যেতে পারব। আর এই দেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারব। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারব। তাহলেই এই হত্যার প্রকৃত প্রতিশোধ হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, বিচারের বাণী তো নিভৃতে কাঁদে। আমি ফিরে এসেও তো বিচার করতে পারিনি। আমি ৮১ সালে দেশে এসেছি, ৯৬ সালে ক্ষমতায় গিয়েছি। এই সময়ে কতবার ওই হাইকোর্টে গিয়েছি, বক্তৃতা দিয়েছি। বিচারিক আদালতে গেছি। আমাদের তো মামলা করারও অধিকার ছিল না। কারণ ইনডেমনিটি দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, জজ সাহেব গোলাম রসূল সাহসী ছিলেন। কোর্টে গিয়েছিলেন এবং বিচারের রায় দিয়ে খুনিদের ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ২০০১ এ যখন আসে, সব বিচার কার্য বন্ধ। এরপর আমরা যখন ক্ষমতায় আসলাম ২০০৯ সালে তখন এই বিচার কাজ শুরু করি। হাইকোর্টে আমরা আপিল করি। বিচারকদের তালিকায় লেখা আওয়ামী লীগের পক্ষের লোক। কোর্টে গেলে তারা বিব্রতবোধ করেন। মানে এই বিচারের রায় তারা দিতে পারবেন না। প্রধান বিচারপতি ছিলেন তোফাজ্জল সাহেব। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। তার রায়ে এই খুনিদের ফাঁসি হয় যেটা আমরা কার্যকর করতে সক্ষম হয়েছি।
তিনি বলেন, আজকে যেসব দেশ মানবাধিকারের প্রশ্ন তোলে আমাদের নিষেধাজ্ঞা দেয় তারা তো খুনিদের আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। এই খুনি রাশেদ ছিল মিলিটারি অর্ডারে যে অপারেশন হয়, তার কমান্ডিং অফিসার। রাশেদ ও শাহরিয়ারের নেতৃত্বে ওখানে যায়.. এবং মাজেদ। মাজেদকে আমরা আনতে পেরেছি। কিন্তু রাশেদকে আনার জন্য বারবার আমেরিকার সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু তারা দিচ্ছে না। তাকে তারা লালন-পালন করে রেখে দিচ্ছে। আর নূর আছে কানাডায়। এদের কাছ থেকে আমাদের মানবতার সবক নিতে হয়! আমাদের মানবতার সবক শেখায় যারা আমার বাবা, মা, নারী-শিশুকে হত্যা করেছে, তারা তাদেরকে রক্ষা করে। রশিদ লিবিয়াতে পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে পাকিস্তানে যায়। ডালিমের খোঁজ…পাকিস্তানের লাহোরে আছে এইটুকু জানি, এর বেশি জানি না। মোসলেম উদ্দিন ভারতের আসামের কোনো অঞ্চলে ছিল, বহু চেষ্টা করেছি তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। নামটাম পাল্টে রয়ে গেছে। তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই কয়জনকে এখনো আনতে পারেনি।