অর্থ আত্মসাৎ-যৌন হয়রানির অভিযোগ আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াজের বিরুদ্ধে

নিজস্ব প্রতিবেদক । ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

অর্থ আত্মসাৎ-যৌন হয়রানির অভিযোগ আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াজের বিরুদ্ধে

রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের (নারী শিক্ষা মন্দির) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে বিদ্যালয়টির সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানা গেছে।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকার এক বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ঢাকা মহানগরীর সূত্রাপুর থানাধীন শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন পদত্যাগ করায় অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য সভাপতি হিসেবে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা ও আইসিটি) মনোনয়ন প্রদান করা হলো।

বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গভর্নিং বডির সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছেন এমনটি নয়। তার বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নানা অনিয়ম, দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতা ও যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদের বরাবর স্মারকলিপি দেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মেলায় রিয়াজ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদের বরাবর বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেওয়া স্মারকলিপিতে বলা হয়, গভর্নিং বডির সভাপতি মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্বেচ্ছাচারিতা, অর্থ ও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। রিয়াজ গভর্নিং বডির সভাপতি হওয়ার পর শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পরিচয় দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ম্যানেজ করে অডিট আটকে রেখে শূন্যের কোটায় এনেছেন বিদ্যালয়ের প্রায় ১৩ কোটি টাকার ফান্ড। বিপুল এ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন রিয়াজ। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মণির দোহাই দিয়ে নিয়মিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হয়রানি করছেন। নারী শিক্ষকদের তিনি তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ ও লংড্রাইভে যেতে প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাবে সাড়া না পেলে তার রোষানলে পড়তে হয় তাদের। এ ছাড়া শিক্ষামন্ত্রীর কাছের লোক পরিচয় দিয়ে তিনি শিক্ষকদের এমপিও বন্ধ এমনকি চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়ে থাকেন। এখানেই শেষ নয়, শিক্ষার্থীদের অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিদ্যালয়টিতে শিক্ষকদের জন্য সিটিং রুম সংকট থাকলেও রিয়াজ নিজের ক্ষমতার দাপটে বিদ্যালয়ে নিজের জন্য অত্যাধুনিক একটি সভাকক্ষ তৈরি করেন। গভীর রাত পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থান করেন। নারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সেখানে বিশেষ প্রয়োজনে সাক্ষাৎ করতে বলেন।

এতে আরও বলা হয়, রিয়াজ বলে থাকেন তার সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মণির বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। রিয়াজ শিক্ষামন্ত্রীর ক্ষমতা ব্যবহার করে সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ ও যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতির পদও বাগিয়ে নেন। যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল কলেজের এক অনুষ্ঠানে ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনু রিয়াজের বিভিন্ন অনিয়মের বিষয় তুলে ধরে বক্তব্য দিলেও শিক্ষামন্ত্রী কোনো ব্যবস্থা নেননি। এতে বিভিন্ন অপকর্মে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন রিয়াজ।

জানা গেছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতা রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজের ঢাকা শহরে জীবন শুরু গুলিস্তানে ঝুড়িতে করে জুতা বিক্রি করার মধ্য দিয়ে। এরপর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজে। মূলত হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজে স্বঘোষিত জিএস পরিচয় দিয়ে সেখানে ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তোলেন তিনি। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয় রিয়াজের হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে জীবন বদলে যাওয়ার চিত্র। তিনি সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ এবং ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অর্থের মালিক হন। ছাত্রলীগের সিন্ডিকেট ম্যানেজ করে বাগিয়ে নেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের (সোহাগ-নাজমুল) কমিটির সহ-সভাপতি পদ। এ ছাড়া তিনি জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের ঢাকা মহানগর নেতা ও হোমিওপ্যাথি বোর্ডের সদস্য ডা. যুবরাজের স্ত্রী ডা. তাহমিনার সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পরে এটি জানাজানি হলে ডা. যুবরাজ গুপ্ত হত্যার শিকার হন। এ ঘটনায় রিয়াজের সম্পৃক্ততা নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।

সূত্র আরও জানায়, এক সময় মাদরাসায় পড়ুয়া রিয়াজ শিবিরের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। ঢাকায় এসে বনে যান ছাত্রলীগ। রিয়াজ শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মণির ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন এটি রাজনৈতিক অঙ্গনে ওপেন সিক্রেট। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের শীর্ষ একজন নেতাকে অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন তিনি। এসব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তিনি বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত হয়ে পড়েন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে দলের সুনাম নষ্ট করতে তৎপর রয়েছে বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ও শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব শিক্ষক ও নারী শিক্ষার্থী যারা যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন, আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করব। একজন পুরুষ মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে মানসম্মান ক্ষুণ্ণ হয়। এ ছাড়া আমার বিরুদ্ধে শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। আমি সভাপতির দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সময় দিতে পারি না, তাই পদত্যাগ করেছি। বরং আমি যখন শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিই, তখন যে টাকা ছিল, তার চেয়ে বেশি টাকা রেখে এসেছি।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফি  বলেন, আমি এমন একটি ঘটনার কথা শুনেছি। তবে এখন পর্যন্ত কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা শুনেছি। রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ যে অপরাধ করেছেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার বিকল্প নেই। তিনি আওয়ামী লীগের নাম ডুবিয়েছেন। একই সঙ্গে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সম্মান ক্ষুণ্ণ করেছেন।