নিজস্ব প্রতিবেদক । ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
জাতীয় জরুরি হেল্পলাইন – ৯৯৯ – চালু করা হয়েছিল নাগরিকদের দুর্ঘটনা, অপরাধ, অগ্নিকাণ্ড বা চিকিৎসা সংক্রান্ত জরুরি পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক সহায়তা দেওয়ার জন্য। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ এই সেবা এখনও আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট এবং একটি ভারতীয় সফটওয়্যার কোম্পানির প্রভাবাধীন রয়েছে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
জাতীয় জরুরি সেবা (৯৯৯) প্রকল্পের ধারণাটি প্রথমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের মাধ্যমে আসে। এটি প্রথমে "৯৯৯-ন্যাশনাল হেল্প ডেস্ক (NHD)" নামে চালু করা হয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের অধীনে পরিচালিত হতো। পরে প্রকল্পটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করা হয় এবং বর্তমানে এটি বাংলাদেশ পুলিশের (পুলিশ টেলিকম) অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার মেট্রোপলিটন পুলিশ ক্রাইম কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে সজীব ওয়াজেদ জয় আনুষ্ঠানিকভাবে এই সেবাটির উদ্বোধন করেন।
আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর কাছে প্রকল্পের হস্তান্তর
প্রকল্পের শুরু থেকেই এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দেওয়া হয়েছিল ডিজিকন টেকনোলজিস লিমিটেডকে, যার মালিক ওয়াহিদুর রহমান শরীফ—সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁরা দুজনই ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস (আর্লিংটন)-এ একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। এছাড়া, প্রাক্তন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (CRI)-এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আবিরের মালিকানাধীন মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন (MCC) লিমিটেডও যৌথভাবে এই প্রকল্পের অংশীদার ছিল।
এই দুটি কোম্পানি "ট্রিনিটি" নামে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে পুরো ৯৯৯ অবকাঠামো তৈরি করে, যা সম্পূর্ণরূপে একটি ভারতীয় কোম্পানির মালিকানাধীন। এই সফটওয়্যারটি জিআইএস ট্র্যাকিং, কল গ্রহণ, কলারের তথ্য, ফোন রেকর্ড এবং সিস্টেম নিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনা করে, যার ফলে ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ডেটা প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নিরাপত্তা উদ্বেগ ও টেন্ডার কারসাজি
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, ২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বর ৯৯৯ কর্তৃপক্ষ "জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর আপগ্রেডেশন ও সম্প্রসারণ" শীর্ষক একটি নতুন টেন্ডার আহ্বান করে। তবে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরও একই সিন্ডিকেট প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করে। যেহেতু ডিজিকন টেকনোলজিস লিমিটেড সরাসরি অংশ নিতে পারছিল না, তাই তারা স্মার্ট টেকনোলজিস নামক অন্য একটি কোম্পানিকে সামনে এনে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রাক-বিড পর্যায়ে একাধিক কোম্পানি ভারতীয় সফটওয়্যারভিত্তিক সমাধানের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি উল্লেখ করে। তবে তাদের আপত্তি উপেক্ষা করা হয়। একাধিক প্রতিষ্ঠান বিড জমা দেওয়ার জন্য মাত্র সাত দিনের সময়সীমা বৃদ্ধির আবেদন করলেও, ৯৯৯ কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করে। অভিযোগ রয়েছে যে, এই সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও ডিজিকনের দীর্ঘদিনের সহযোগী অতিরিক্ত ডিআইজি তাবারক উল্লাহর প্রভাবে নেওয়া হয়েছিল।
জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, একটি জাতীয় জরুরি পরিষেবার বিদেশি নিয়ন্ত্রিত সফটওয়্যারের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া গুরুতর নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করে। এতে জরুরি সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর রিয়েল-টাইম অবস্থানসহ সংবেদনশীল তথ্য বাইরের দেশে প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।
৯৯৯ পরিষেবা স্থানীয়ভাবে উন্নত সফটওয়্যারের মাধ্যমে পরিচালিত করার দাবি জোরালো হচ্ছে। স্বচ্ছ ও স্বাধীন একটি বিডিং প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে অপচয় রোধ করা যায় এবং বাংলাদেশের জরুরি সেবার স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা বজায় থাকে।