সড়ক সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে ওবায়দুল কাদের

নিজস্ব প্রতিবেদক । ২২ মার্চ ২০২৩

সড়ক সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে ওবায়দুল কাদের

দেশে আরেকটি বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটল। মৃত্যু হলো ১৯ জনের। এরপর জানা গেল, দুর্ঘটনায় পড়া বাসটির চালক সর্বশেষ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টার বেশি বাস চালিয়ে ক্লান্ত ছিলেন। বাসটি চালানোর অনুমোদন ছিল না, ফিটনেস সনদের মেয়াদও পেরিয়ে গেছে।

দুর্ঘটনাটি ঘটে গত রোববার মাদারীপুরের শিবচরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্সপ্রেসওয়েতে। এর আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজারের চকরিয়ায় পিকআপচাপায় একসঙ্গে ছয় ভাই নিহত হওয়ার পর বেরিয়ে আসে যে পিকআপটির অনুমোদনসংক্রান্ত হালনাগাদ কোনো কাগজপত্র ছিল না। চালকেরও লাইসেন্স ছিল না।

এভাবে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, হয় সংশ্লিষ্ট বাহনের চলাচলের অনুমোদন বা রুট পারমিট নেই, নয়তো ফিটনেস সনদ নেই। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সড়কে এই নৈরাজ্য চলছে বহু বছর ধরে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় নৈরাজ্য দূর করার ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। মন্ত্রণালয়টি শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়, বাস ও অটোরিকশায় নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করা, অধীন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সেবা সহজ করা ও দুর্নীতি কমানো, সড়কের মান উন্নত করা এবং সময়মতো ও নির্ধারিত ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা—এসব ক্ষেত্রেও কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে দেশে ভাড়া নিয়ে বচসার কারণে যাত্রীকে মার খেতে হচ্ছে, বাসচাপায় মরতে হচ্ছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে মন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন ওবায়দুল কাদের। দায়িত্ব নিয়ে শুরুর দিকে তিনি মাঠেঘাটে, সড়কে দৌড়াতেন। অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। প্রকাশ্যে কর্মকর্তাদের ধমকও দিতেন। ‘মাসুদ ভালো হয়ে যাও’—তাঁর এই বক্তব্য তো সবার মুখে মুখে।

মন্ত্রীর এই তৎপরতা মানুষের মনে আশা জাগিয়েছিল। যাত্রীরা ভেবেছিলেন, এবার বুঝি পরিবর্তন আসবে। অবশ্য মন্ত্রী হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের মেয়াদ ১১ বছর পার হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, সড়কে শৃঙ্খলা আসেনি, বরং মৃত্যু বেড়েছে।
ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী থাকা অবস্থায়ই পদ্মা সেতু হয়েছে এবং মেট্রোরেলের মতো কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে। তবে এসব কাজ সরকারের অগ্রাধিকার বা ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতাধীন। বাস্তবায়নে তদারকি করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও। শুধু সড়ক মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা যেসব প্রকল্পে, সেগুলোর মেয়াদ ও ব্যয় বারবার বাড়ানো হচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে উদাহরণ বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পটি (বিআরটি)। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার পথে বিশেষ বাস চালুর লক্ষ্যে এই প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালে। ২০১৬ সালে বিআরটি চালুর কথা ছিল। এখনো শেষ হয়নি। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। অব্যবস্থাপনার কারণে বিআরটি প্রকল্প এক দশকের বেশি সময় ধরে মানুষকে ভোগাচ্ছে। সঙ্গে দুই দফা গার্ডার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন সাতজন।

স্বাধীনতার পর থেকে দেশে যোগাযোগ বা পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ২৫ জন। এঁদের কেউ সাত বছরের বেশি দায়িত্বে ছিলেন না। একমাত্র বর্তমান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দায়িত্ব পালন করেছেন টানা এক দশকের বেশি সময় ধরে। তিনি তিন মেয়াদ ধরে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মন্ত্রী হিসেবে নিজের কাজ করতে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দরকার, সেটা ওবায়দুল কাদেরের রয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি।
যেকোনো মন্ত্রণালয়ের প্রধান ব্যক্তি মন্ত্রী। সচিব প্রশাসনিক প্রধান। মন্ত্রণালয় কোনো কাজে সফল না হলে দায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপরই বর্তায় বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ৮ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে সড়কমন্ত্রীর কাছে এই প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, তিনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা আনা, দুর্ঘটনা কমানো ও যানজট নিরসনকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। সে অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ার বিষয়টিকে তিনি কীভাবে দেখেন। জবাবে তিনি বলেন, ‘কর্মে, কর্তব্য পালনে একজন মানুষ কখনোই পারফেক্ট (পরিপূর্ণ) নয়। চাঁদেরও কলঙ্ক আছে, এর জন্য কি চাঁদের উজ্জ্বলতা হারিয়ে গেছে? কাজ করতে গেলে কিছু ব্যর্থতা তো থাকবেই। সফলতার মধ্যে ব্যর্থতা আছে, শতভাগ সফলতা সম্ভব না।’

সূত্র - প্রথম আলো