নিজস্ব প্রতিবেদক । ২৪ জুন ২০২৩
রাশিয়ার ‘প্রাইভেট আর্মি’ ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন বলেছেন, রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বকে উৎখাত করে তবেই তিনি মরবেন।
এর কয়েক ঘণ্টা আগে রাশিয়া তার বিরুদ্ধে সামরিক বিদ্রোহের অভিযোগ আনে।
ইয়েভগেনি প্রিগোজিন বলেন, ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধারা ইউক্রেনের সীমান্ত অতিক্রম করে রাশিয়ার রোস্তভ-অন-দন শহরে প্রবেশ করেছে।
এদিকে রাশিয়া থেকে আসা খবর অনুযায়ী, ইয়েভগেনি প্রিগোজিন রোস্তোভ-অন-দন শহরে রুশ সেনাবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।
একটি ভিডিওতে ইয়েভগেনি প্রিগোজিনকে সদর দপ্তরে প্রবেশ করতে এবং সেখানে অবস্থানরত সামরিক কমান্ডারদের সাথে হাত মেলাতে দেখা যায়।
এক ভিডিওতে ইয়েভগেনি প্রিগোজিন বলেছেন, রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভক যদি তার সঙ্গে দেখা করতে না আসেন, তাহলে তিনি মস্কোর দিকে রওনা হবেন।
প্রিগোজিন বলেন, আমরা এখানে সেনাপ্রধান ও শোইগুর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তারা না আসা পর্যন্ত আমরা এখানেই থাকব, রোস্তভ শহর অবরোধ করব এবং তারপর মস্কোর দিকে অগ্রসর হবো।
এদিকে মস্কোর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর সংযোগকারী প্রধান মহাসড়ক এম ফোর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। লিপেটস্ক প্রদেশের গভর্নর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এম ফোর হাইওয়ে রোস্তভ এবং মস্কোকে সংযুক্ত করে।
প্রাদেশিক গভর্নর নাগরিকদের শান্ত থাকতে এবং ঘরের ভেতরে থাকতে বলেছেন। রয়টার্স রোস্তভের রাস্তায় অবস্থানরত ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধাদের ছবি প্রকাশ করেছে।
এদিকে ইয়েভগেনি প্রিগোজিন দাবি করেছেন, তার যোদ্ধারা একটি রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছে।
তবে তিনি ঘটনার স্থান নির্দিষ্ট করেননি এবং তাৎক্ষণিকভাবে তার দাবি যাচাই করা কঠিন।
ওয়াগনার গ্রুপ ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি লড়াই করা বেসরকারি যোদ্ধাদের একটি সেনাবাহিনী।
যুদ্ধে লড়াইয়ের পদ্ধতি নিয়ে ওয়াগনার গ্রুপ এবং রুশ সামরিক বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছিল। ইয়েভগেনি প্রিগোজিন ক্রমশই রাশিয়ার সামরিক কমান্ডারদের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছিলেন।
শুক্রবার ৬২ বছর বয়সী ইয়েভগেনি প্রিগোজিন রাশিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর অভিযোগ করেন। তবে তিনি এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেননি।
রুশ কর্মকর্তারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তাদের উচিত অবিলম্বে অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধ করা।
ইয়েভগেনি প্রিগোজিন বলেছেন, রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের ওপর আধিপত্য বিস্তারকারী অশুভ শক্তি দমন করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ন্যায়বিচারের জন্য তিনি এগিয়ে যাবেন।
প্রিগোজিন বলেন, যে কেউ আমাদের বিরোধিতা করবে তাকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং ধ্বংস করা হবে। পথে আসা সব চেকপয়েন্ট ও বিমানের ক্ষেত্রেও একই বার্তা।
প্রিগোজিন আরও বলেছেন, এটি কোনো সামরিক অভ্যুত্থান নয়, এটি ন্যায়বিচারের লড়াই। প্রেসিডেন্টের কার্যালয়, সরকার, পুলিশ ও রুশ রক্ষীরা আগের মতোই কাজ করে যাবে। এটা সামরিক অভ্যুত্থান নয়, ন্যায়বিচারের লড়াই। আমাদের কার্যকলাপ সৈন্যদের পথে হস্তক্ষেপ করবে না।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখপাত্র বলেছেন, প্রেসিডেন্ট পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং প্রতি মুহূর্তে ঘটনাবলী সম্পর্কে তথ্য নিচ্ছেন।
এদিকে শুক্রবার রাত থেকে রাজধানী মস্কোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সরকারি ভবন ও ট্রাফিক হাবগুলোতে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
একই সঙ্গে লিপেৎস্ক প্রদেশের গভর্নর নাগরিকদের দক্ষিণে ভ্রমণ না করার আহ্বান জানিয়েছেন।
লিপেৎস্ক ইউক্রেন সীমান্ত থেকে প্রায় ২৮০ কিলোমিটার এবং রোস্তভ থেকে ৫০০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
শুক্রবার রাতে এক টুইটবার্তায় রুশ সামরিক বাহিনী বলেছে, আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করবে।
এদিকে, জেনারেল সুরোভিচিন এক বার্তায় প্রিগোজিনকে তার গাড়িবহর থামিয়ে ঘাঁটিতে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
জেনারেল সুরোভিচিন ইউক্রেনে রাশিয়ান বাহিনীর উপপ্রধান এবং অতীতে প্রিগোজিনের প্রশংসা করেছেন।
জেনারেল সুরোভিচিন বলেন, আমাদের রক্ত একই, আমরা যোদ্ধা। আমাদের কঠিন সময়ে শত্রুর হাতের পুতুল হওয়া উচিত নয়।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের আহ্বান জানানোর অভিযোগে প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে রাশিয়ার ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এফএসবি)। প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে রাশিয়ায় সামরিক অভ্যুত্থান চালানোর অভিযোগও রয়েছে।
এফএসবি ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধাদের প্রিগোজিনের আদেশ না মানতে এবং তাদের ধরার পদক্ষেপ নিতে বলেছে।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধাদের ওপর রাশিয়ার হামলা নিয়ে প্রিগোজিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব প্রতিবেদন ছড়িয়েছেন তা ভুয়া।
মে মাসের শুরুতে প্রিগোজিন যোদ্ধাদের মৃতদেহের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধাদের পর্যাপ্ত অস্ত্র না দেওয়ার জন্য রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সামরিক কমান্ডারদের সমালোচনা করার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন।
বিশ্বাস করা হয় যে হাজার হাজার ভাড়াটে সৈন্য ওয়াগনার গ্রুপের সাথে ইউক্রেনে রাশিয়ার পক্ষে লড়াই করছে।
সম্প্রতি ওয়াগনার গ্রুপের সৈন্যরা ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বাখমুত শহরটি দখল করার জন্য দীর্ঘ লড়াই করেছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ওয়াগনার গ্রুপ নিজেকে একটি ‘বেসরকারি সামরিক সংস্থা’ হিসেবে বর্ণনা করে। তবে এখন রুশ সরকার এই গোষ্ঠীকে দমন করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, কারণ এর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার দাবি করেছেন।
ওয়াগনার গ্রুপটি ২০১৪ সালে প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিল, যখন তারা ইউক্রেনে রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে সমর্থন করেছিল।
সে সময় এটি একটি গোপন দল ছিল, যার বেশিরভাগ সদস্য আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয় ছিল এবং এটি বিশ্বাস করা হয় যে সেই সময়ে এই গ্রুপটি মাত্র পাঁচ হাজার যোদ্ধা নিয়ে গঠিত ছিল, তবে তাদের বেশিরভাগই রাশিয়ার বিশেষ বাহিনীর সৈন্য ছিল।
ওয়াগনার গ্রুপের একজন যোদ্ধা কত টাকা পায়?
ধীরে ধীরে দলে যোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকে। গত জানুয়ারিতে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ইউক্রেনে রাশিয়ার পক্ষে ওয়াগনার গ্রুপের প্রায় ৫০ হাজার যোদ্ধা রয়েছে।
সংস্থাটি ২০২২ সালে গণনিয়োগ করেছিল কারণ রাশিয়া তার সেনাবাহিনীতে লোক নিয়োগে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিল।
চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ জানায়, ইউক্রেনে যুদ্ধরত ওয়াগনার গ্রুপের প্রায় ৮০ শতাংশ যোদ্ধাকে কারাগার থেকে বের করে আনা হয়েছে।
ওয়াগনার গ্রুপের একজন সাবেক সৈনিক বিবিসিকে বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের আগে যারা এই গ্রুপে যোগ দিয়েছিল তারা ছোট ছোট গ্রাম থেকে এসেছিল। এই গ্রামগুলোতে ভালো বেতনের চাকরি পাওয়া কঠিন ছিল। এ কারণে তারা এই গ্রুপে যোগ দেন।
ওয়াগনার গ্রুপে যারা কাজ করেন তারা ১৫০০ ডলার (দেড় লাখার টাকার বেশি) বেতন পান। যদি কোনো সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে যান তবে তিনি আরও বেশি (দুই লাখ টাকার বেশি) পান।
তবে রাশিয়ায় ভাড়াটে সৈন্য নিষিদ্ধ। ওয়াগনার গ্রুপ ২০২২ সালে একটি সংস্থা হিসেবে নিজেকে নিবন্ধিত করে এবং সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি নতুন অফিস খোলে।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউটের ড. স্যামুয়েল রামানি বলছেন, ওয়াগনার গ্রুপ রাশিয়ার শহরগুলোতে বিলবোর্ড লাগিয়ে প্রকাশ্যে যোদ্ধা নিয়োগ করছে এবং একটি দেশপ্রেমিক সংগঠন দেখিয়ে রাশিয়ার গণমাধ্যমে তাদের নিয়ে প্রচারণা চালানো হয়েছে।
রাশিয়া যখন পূর্ব ইউক্রেনের বাখমুত শহর দখল করে, তখন ওয়াগনার গ্রুপ এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইউক্রেনের সৈন্যরা বলছে, ওয়াগনার গ্রুপের বিপুল সংখ্যক যোদ্ধাকে উন্মুক্ত মাঠে পাঠানো হয়েছিল, এতে তাদের অনেক লোক নিহত হয়।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমে যুদ্ধে ওয়াগনার গ্রুপের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও পরে সাহসী ও নিঃস্বার্থ ভূমিকা পালনের জন্য ভাড়াটে সৈন্যদের প্রশংসা করে।