নিজস্ব প্রতিবেদক । ২৭ জুন ২০২২
পৃথিবীর ঠিক উল্টো পীঠে বসে আমরা চেয়ে চেয়ে দেখি একটি সেতুর রূপ। কি অপরূপ সাজে সাজানো হয়েছে এই সেতু। মিডিয়ার কল্যাণে কত ছবি, ভিডিও চোখে পড়ছে। আর মুগ্ধ হচ্ছি। তবে শুধু রূপে নয়, এমন এক শক্ত কাঠামো দেওয়া হয়েছে এই সেতুতে যা শতবর্ষের জন্য সকল ধকল নিতে প্রস্তুত। যার মধ্য দিয়ে দেখছি ১০০ বছর পরের বাংলাদেশকেও।
আমরা জানি, উন্নয়নের আরেক নাম গতি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দ্রুততম গতির সংযোজন ঘটিয়ে চলছে নানাবিধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। ফলে আমরা দূর পরবাস থেকেও দেখতে পাই একটি গতিময় সময়ে গতিময় বাংলাদেশকে। যার সর্বশ্রেষ্ঠ সংযোজন এই পদ্মাসেতু। গত ২৫ শে জুন সেতুটি উদ্বোধন হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন যুগে পা ফেলেছে ।আমি মনে করি এই পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতির গেম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যদি মিলিয়ে দেখি, এই দেশে আমরা কী দেখতে পাই? এই দেশে একটি রাজ্যের সঙ্গে অন্য রাজ্যের কানেক্টিভিটির দিকে যদি তাকাই আমরা দেখি অত্যন্ত সুচারূরূপে রচনা করা হয়েছে সেই কানেক্টিভিটি। কোথাও পাহাড়ের খাঁজ কেটে, কোথাও নদীর উপর সেতু রচনা করে। মূলতঃ যোগাযোগটাই উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। সেই হিসেবে এখানে রাজ্যগুলো একে অন্যের সাথে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় সংযুক্ত। আর সে কারণে এই দেশে মানুষগুলো যার যে রাজ্যে মন চায় গিয়ে বসতি গাড়ে। কারণ রাজ্যে রাজ্যে দ্রব্যমূল্যে নেই বড় কোনো ফারাক। ফারাক নেই জীবন ব্যবস্থায়। জীবনাচারে প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণে।
একটি উদাহরণ দেই- এই দেশে ফ্লোরিডার আবহাওয়া অনেকটা গ্রীস্মমণ্ডলীয় দেশগুলোর মতো। ফলে সেখানে ফলে আম, জাম, লিচুর মতো রসালো ফলগুলো। কিন্তু সেই ফল আমরা ভার্জিনিয়াতে বসেও কিংবা নিউইয়র্কে বসে কিনে খেতে পারি অনেকটা সমমূল্যে। কারণ অতি সহজেই সেইসব ফল যুক্তরাষ্ট্রের অন্য রাজ্যগুলোতে পৌঁছে যায়। কারণ একটাই সহজ ও সাবলীল যোগাযোগ ব্যবস্থা।
আমি মনে করি পদ্মাসেতু বাংলাদেশের জন্য সেই সুযোগটিই সবচেয়ে বড় করে আনবে। সবচেয়ে বড় কথা কাছাকাছি টেনে আনবে মানুষগুলোকে। এখন আর দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের মানুষকে দূরের মনে হবে না। কিংবা রাজধানী ঢাকাকেও দূরের কোনো নগরী মনে হবে না সেই অঞ্চলের মানুষগুলোর কাছে। এই কাছাকাছি করে আনার মধ্য দিয়ে যে কাজের একটি শক্ত ভিত রচিত হবে যা উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।
গত কয়েকটি বছর পদ্মাসেতুর নির্মাণ প্রক্রিয়া দৃষ্টি কেড়েছে সকলের। আমরাও অবাক হয়ে দেখেছি কতটা আত্মনিয়োজনে তৈরি হয়েছে এই সেতু। সেতুর উপকরণ হিসেবে বিশ্বের যেখানে যেটি শ্রেষ্ঠ সেই উপকরণটিই সেই দেশ থেকে আনা হয়েছে। ফলে গুণগত মানে এতটুকু ছাড় না দিয়ে তৈরি হওয়া সেতুকে স্রেফ স্বপ্নের সেতু না বলে একটি ভিশনারি সেতুও বলা চলে। যাতে নিশ্চিত করা হয়েছে শতবর্ষের ভিত।
সোয়া ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুতে উপরের তলায় প্রস্তুত হয়েছে চার-লেনের হাইওয়ে, আর নিচের তলায় সিঙ্গেল ট্র্যাক রেলওয়ে। সাড়ে সাত বছর ধরে ৩.৬ বিলিয়ন ডলার খরচে বানানো হয়েছে এই সেতু। বিশ্বের ২০ টি দেশের প্রকৌশলীদের প্রকৌশল বিদ্যার প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে এই সেতুতে। ১০টি দেশ থেকে এসেছে এই সেতুর প্রধান উপকরণগুলো। আর বিশ্বের অন্তত ৫০টি দেশ থেকে আসা কোনো না কোনো উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে এই সেতুতে।
এই যে আমরা আমাদের উন্নয়ন ও নির্মাণ প্রক্রিয়া অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখতে শিখলাম। শ্রেষ্ঠত্বের প্রয়োগ ঘটাতে শিখলাম। এই চর্চা আমাদের শুরু হলো। এটাই আমাদের সময়ের তরফ থেকে হয়ে থাকবে ভবিষ্যত সময়ের জন্য এক উপহার। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যা গর্বের প্রতীক হয়ে থাকবে।
আমি ব্যবসায়ী দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপুল এক গতির সঞ্চার করবে এই সেতু। কাচামালের দ্রুত যোগান মানেই শিল্পের উৎপাদন তরান্বিত হওয়া সেতো আছেই কিন্তু যে কৃষক ফসল ফলায় মাঠে, তার উৎপাদিত পণ্যও এখন স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পৌঁছে যাবে ক্রেতা কিংবা ভোক্তার কাছে ফলে কৃষি-বাণিজ্য তরান্বিত হবে। যে মানুষটি রাজধানী শহরে যেতে চায় কাজের খোঁজে তার জন্য শহরটি কাছাকাছি হবে, ফলে তার বেকারত্ব ঘুচবে। কিন্তু সেতুপথ তো একদিকে ধাবিত নয়, এর সমান দুটি লেন দুই দিকে ধাবিত, অর্থাৎ রাজধানীমুখি যেমন মানুষ হতে পারবে, তেমনি রাজধানির সুবিধাগুলো পৌঁছে যাবে সেই মানুষের কাছে। উভয়পথেই একটি নতুন দিনের সূচনা হবে। ফলে, যেমনটা বলছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রে মানুষ যেমন যে কোনো রাজ্যে গড়তে পারে তার স্বস্তির, সম্মৃদ্ধির নিবাস, তেমনি বাংলাদেশেও মানুষগুলো তাদের ইচ্ছে মতো থাকতে পারবে সেতুর মাধ্যমে সংযুক্ত যে কোনো জেলায়, একই সুযোগ সুবিধা নিয়ে।
আর কেবলতো সড়কপথই নয়, সেতুতে রেলপথও রয়েছে। ফলে দ্রুতগতির ট্রেন এখন গোটা বাংলাদেশে তার রুটগুলো তৈরি করে নিতে পারবে। এখানেও একটু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাই। এখানেও অধিকাংশ স্টেট সড়কপথের পাশাপাশি ট্রেন লাইনেও সংযুক্ত। যা যোগাযোগের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করেই উন্নয়নে গতি দেয়। আর নিশ্চিত করে বিকেন্দ্রীকরণ। আমরা এখন স্পষ্ট করেই ধারনা করতে পারছি এক উন্নত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল যা হয়তো আগামী ৫-৭ বছরেরই চাক্ষুস করতে পারবো।
এই সেতু এইসব অঞ্চলের দারিদ্র বিমোচন করবে। অর্থনীতিকে করে তুলবে অন্তর্ভূক্তিমূলক আর অংশগ্রহণমূলক। সড়ক ও রেলপথে নতুন যে নেটওয়ার্ক তৈরি হবে তাতেই উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এসব অঞ্চলে। নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি করবে। কমবে মানুষের যাতায়াত খরচ, পণ্য পরিবহণ খরচ ও সময়। এতে অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ থেকে এখনই স্পষ্ট হচ্ছে, স্রেফ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোর অতিরিক্ত সক্রিয়তায় আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের সার্বিক জিডিপি ২ শতাংশ বেড়ে যাবে।
এই সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশ নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করলো। বিশ্বকে দেখালো যে, বাংলাদেশ পারে। বস্তুত মানুষ চাইলেই পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা আর বাংলাদেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনই এই সেতু তৈরির প্রধান ভিত। এর মধ্য দিয়েই আপাত অসম্ভব মনে হওয়া একটি কাজ সম্ভব করে তুললো বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশ সেটা করলো স্রেফ নিজস্ব অর্থায়নে।
দূর প্রবাসে বসে সেই গর্বে গর্বিত আমি ও আমরা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এর মধ্যদিয়ে একজন বাংলাদেশি আমেরিকান হিসেবে আমরা এদেশেও গর্ব করতে পারবো। বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে কতবড় ভুল ছিলো তার এক জাজ্বল্যমান প্রমাণ এই পদ্মাসেতু। সে কথা আমরা বলতে পারবো জনে জনে। বুক ফুলিয়ে বলতে পাবরো, আমরাও পারি। আমাদের সকলের গর্বের প্রতীক এই পদ্মাসেতু। পদ্মাসেতুকে ঘিরে আমাদের আগামী দিনের গল্পগুলো হোক কেবলই সাফল্যের আর এগিয়ে চলার।