নিজস্ব প্রতিবেদক । ২৯ জুলাই ২০২৪
যাত্রাবাড়ি থানা আওয়ামী লীগের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক প্রস্তাব করা হয়েছে শান্ত নুর খান শান্তের নাম। চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস ও জমিদখলসহ শান্তের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। নানা কর্মকান্ডে বিতর্কিত ব্যক্তি তিনি। রাজনীতিতে অপরিপক্ক ও জুনিয়র। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফীকে বড় অংকের অর্থ বিনিময়ে পদ বাগিয়েছেন। এসব অভিযোগ যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার।
জানতে চাইলে ৪৮ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাউন্সিলর আবুল কালাম অনু বলেন, আমরা যারা ২০ থেকে ৩০ বছর ‘সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক’ দায়িত্ব পালন করছি। আমাদের পাশ কাটিয়ে একজন জুনিয়র, অদক্ষ ও বিতর্কিত ব্যক্তির নাম টাকার বিনিময়ে প্রস্তাব করা হয়। এটা মেনে নিতে পারি না। কোন ভাবেই গ্রহণ করি না। তিনি বলেন, আমরা এমন বিষয়ের প্রতিকার চেয়ে নেত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। অবশ্যই নেত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দেবেন। এক প্রশ্নের জবাবে আবুল কালাম বলেন, টাকার বিনিময়ে কমিটিতে নাম প্রস্তাব নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ দুই নেতার বিতর্কিত কর্মকান্ডকে ঘৃণা জানাতেই হচ্ছে।
কয়েকদিন আগে যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে কথা হয় সরেজমিনে। সে-সময় কয়েকজন নেতা প্রস্তাবিত কমিটির নানা অনিয়ম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগ। অথচ, সাধারণ সম্পাদকের প্রস্তাব করা হয়েছে জুনিয়র অদক্ষ ও বিতর্কিত ব্যক্তির (শান্ত) নামে। প্রস্তাবিত কমিটি নিয়ে নগর শীর্ষ দুই নেতা আবু আহমেদ মন্নাফী ও হুমায়ুন কবিরের অযথাচিত সিদ্ধান্তে হতাশার কথাও তারা জানান।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, মাতুয়াইল ইউনিয়ন আওয়াী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে থেকেও শান্তনুর শান্ত নানা সময় আওয়ামী লীগ বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িয়েছেন। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-৫ আসনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেন।
এরআগেও আসনটির আরেক এমপি কাজী মনিরুল ইসলাম মনুর বিপক্ষে তিনি কাজ করেছেন। নেতারা বলেন, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে শান্তর বিতর্কিত কর্মকান্ড আওয়ামী লীগকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছে। এমন বিতর্কিত লোককে প্রস্তাবিত করা হয়? এটা কল্পনাই করা যায় না!
এদিকে, শুধু শান্তনুর খান শান্ত-ই নয়।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের থানা ও ওয়ার্ড কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের প্রস্তাবিত তালিকায় অসংখ্য বিতর্কিত ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। যাদের নামে ভূমিদস্যুতা, দখলবাজ, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, চাঁদাবাজ, কিশোর গ্যাংয়ে জড়িত, ক্যাসিনোকান্ডে জড়িত, হত্যা মামলার আসামিরা সহ নানাবিধ অপরাধমুলক কর্মকান্ডে বিদ্যমান অভিযোগ। এছাড়া আওয়ামী লীগের কোন ধরনের পদ-পদবি তো দূরের কথা; দলের সাধারণ সদস্যও নন, এমন ব্যক্তিরাও থানা-ওয়ার্ডের কমিটিতে প্রস্তাবিত নামের তালিকায় আছেন। নাম রয়েছে, বিএনপি-জামায়াত সমর্থকেরও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রস্তাবিত কমিটি নিয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির-এর চরম সেচ্ছাচারিতা,অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে থানা ও ওয়ার্ড নেতারা। বিশেষ করে ওই দুই নেতার নিজের কোঠা, সন্তানের বন্ধু কোঠা, ভাই ও স্বজনদের কোঠার বিরুদ্ধে যোগ্য ও ত্যাগী নেতারা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এদিকে, প্রস্তাবিত কমিটি গঠনে ওই নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পদকের অনিয়ম এবং আর্থিক দুর্নীতির কথা উল্লেখ করে পদপ্রত্যাশী অনেক নেতাই আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় দফতর, দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অপরদিকে, দক্ষিণ আওয়ামী লীগের মতোই উত্তর আওয়ামী লীগের থানা ও ওয়ার্ড কমিটিতে প্রস্তাবিত তালিকায় অনেক নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। নেতা বানানোর কথা বলে বড় অংকের টাকা নিয়েছেন ওই নগর সভাপতি। এমন অডিও ভাইরাল হয়েছে।
তবে, আওয়ামী লীগ উচ্চ পর্যায়ের এক সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত নাম এবং দুই নগর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে যে, আর্র্থিক লেনদেন অভিযোগ আনা হয়েছে। সেটি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে তদন্ত ও যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় সভাপতি। তবে গণভবনের এক সূত্রে জানা যায়, কমিটিতে নানা অনিয়ম ওঠায় প্রস্তাবিত নাম আপাতত প্রকাশ হচ্ছে না।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি বজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মান্নান কচি গত ৪ জুন, ২৬ থানা ও ৬৪ ওয়ার্ড। দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ১৬ জুন, ২৪ থানা ও ৭৫ ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটি কেন্দ্রীয় দফতরে জমা দেন। ঢাকা-৯ আসনভুক্ত খিলগাঁও, সবুজবাগ ও মুগদা থানার জন্য আলাদা কমিটি জমা দেন মন্নাফী ও হুমায়ুন। এসব কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হয়। ২০২২ সালের অক্টোবরে মহানগরীর থানা-ওয়ার্ড সম্মেলনের এক বছর আট মাস পর কমিটিগুলো জমা পড়ে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে কমিটি গঠন করা হয়।
শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে উঠেছে গুরুতর অভিযোগ। জানা গেছে, ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে এ থানা আওয়ামী লীগে প্রস্তাবিত কমিটির সভাপতি করা হয়েছে জিএম আতিকুর রহমানকে। নানা কর্মকান্ডেই বিতর্কিত আতিকুর রহমান। আর ৪০ লাখ টাকার বিনিময়ে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রস্তাব করা হয়েছে কাউন্সিলর আসাদকে। চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা সহ আসাদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত নানা কর্মকান্ডের রয়েছে অভিযোগ। আতিকের নাম প্রস্তাব করেছেন নগর সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী।
অপরদিকে, আসাদের নাম প্রস্তাব করেছেন মন্নাফীর ছেলে কাউন্সিলর ইমতিয়াজ আহমেদ গৌরব। শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেন, কাউন্সিলরদের পদে আনার বিষয়ে নেত্রীর যে নির্দেশনা ছিল। সেটি উপেক্ষা করে টাকার বিনিময়ে পদ দেয়া হয়েছে। আবার এই থানায় সভাপতির পদ দেয়ার কথা বলে সহিদুল ইসলাম সহিদের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা নিয়েছেন নগর সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির। একইভাবে সাধারণ সম্পাদকের পদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরেক নেতার কাছে থেকে বিভিন্ন সময় ৩০ লাখ টাকা নিয়েছেন হুমায়ুন কবির। কিন্তু তিনি কাউকে পদ দিতে পারেননি।
আবারও সভাপতি পদ পেতে ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের গিয়াস উদ্দিন গেসু নগর সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরকে ১৫ লাখ টাকা এবং দুটি দলীয় কর্মসূচিতে আইড়মাছ সরবরাহসহ ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। এখন তাঁর বদলে আরেকজনের নাম প্রস্তাব করায় ২০ লাখ টাকা ফেরত চান তিনি। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর লিখিত অভিযোগে তিনি কথা জানিয়েছেন। জানতে চাইলে গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমি ৩ বার হজ্জ করেছি। মসজিদঘর ও পবিত্র কুরআন শরীফ নিয়ে কসম করে বলতে পারি হুমায়ুন কবির আমার কাছে থেকে টাকা নিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে হুমায়ুন কবির এর ছেলে প্রফেসর রকির চেম্বারের নিচের রাস্তায় মাইক্রোবাসের মধ্যে ১৫ লাখ টাকা নিয়েছেন।
৬২ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পেতে কয়েক লাখ টাকা খচর করেছেন আব্দুর রহমান রতন। তার দাবি বেশি টাকা পেয়ে নগর সভাপতি ওই পদে কাউন্সিলর মোস্তাক আহমেদের নাম প্রস্তাব করেছেন। জানতে চাইলে আব্দুর রহমান বলেন, নগর সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তোরারক হোসেন ১ লাখ টাকা নিয়েছেন। দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে টাকা দিতে হয়েছে।
৯ নং ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুর রহমান চৌধুরী ওয়াহিদের বিরুদ্ধে রয়েছে দিলকুশাসহ বিভিন্ন এলাকায় একাধিক জায়গা দখল ও মাদক কারবারের অভিযোগ। মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মন্নাফীর ছেলে ৩৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইমতিয়াজ আহমেদ গৌরবের বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার হওয়ার কারণে এ ওয়ার্ডে ওয়াহিদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। ১০ নং ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক হিরকের বিরুদ্ধে আছে হত্যা-চাঁদাবাজির মামলা এবং ১১ নং ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত সাধারণ সম্পাদক বি এম ফরহাদ অংকুরের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে।
২০ নং ওয়ার্ডে প্রস্তাবিত সভাপতি হাসান মাহমুদ একই ওয়ার্ড যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বিএনপির বিতর্কিত নেতা ও সাবেক কমিশনার চৌধুরী আলমের ক্যাডার ছিলেন। একই ওয়ার্ডে প্রস্তাবিত সাধারণ সম্পাদক শাহজালাল সোহেলের বিরুদ্ধে মাদক কারবারের অভিযোগে শাহবাগ থানায় মামলা রয়েছে।
২১ নং ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন শাওন বিএনপি ঘরোনার; তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
মন্নাফীকে দামি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-২১-৬৩৩১) উপহার দিয়ে রমনা থানার সাধারণ সম্পাদক পদে নিজের নাম প্রস্তাবে উঠিয়েছেন গোলাম মোস্তফা শিমুল। বিলুপ্ত সারুলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হাজি মোহাম্মদ আলী লিখিত অভিযোগে বলেন, ৬৭ নং ওয়ার্ড সভাপতি পদে তাঁর নাম প্রস্তাবের বিনিময়ে ২০ লাখ টাকা দাবি করেন মন্নাফী।
বিপুল টাকার বিনিময়ে মন্নাফী কদমতলী থানার সাধারণ সম্পাদক পদে ৪৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিককে প্রস্তাব করেছেন।
৩৮ নং ওয়ার্ডের সভাপতি পদে মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মন্নাফীর ছেলে ইমতিয়াজ আহমেদ গৌরবের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। গৌরবের বিরুদ্ধে কাপ্তানবাজারের মুরগির ব্যবসা ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণসহ আশপাশের এলাকা দখলে রাখার অভিযোগ রয়েছে।
মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের ভাই কাউন্সিলর মকবুল হোসেনকে লালবাগ থানার সভাপতি এবং ভাগনে বখতিয়ার জামিল হোসেনকে ২৬ নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক পদে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী বলেন, অনেক পদ প্রত্যাশী থাকেন। বাদ পড়া ব্যক্তিরাই মিথ্যা অভিযোগ করেন। কারও কাছ থেকে টাকা বা উপহার নিইনি। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, অর্থের বিনিময়ে পদ দেয়া এই অভিযোগ অসত্য ও ভিত্তিহীন। আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে কোনো কোনো মহল এই মিথ্যাচার করছে।