নিজস্ব প্রতিবেদক । ৩০ আগস্ট ২০২৩
জাল ফেললেই ধরা পড়ছে হাজার হাজার ইলিশ। এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ ৬০০ টাকা বিক্রি করলেও লাভ থাকে। কক্সবাজার উপকূলে ১৪ আগস্ট থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ছে। ১৫ দিনে জেলার বিভিন্ন মৎস্যকেন্দ্র থেকে ৪ হাজার ৮০০ মেট্রিক টনের বেশি ইলিশ সারা দেশে সরবরাহ করা হয়েছে। প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়লেও বাজারে দাম কমছে না।
এর কারণ হিসেবে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পর থেকে ট্রলারমালিকদের মুক্ত হতে না পারা এবং ঢাকার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা বলছেন কক্সবাজারের মৎস্য ব্যবসায়ী, ট্রলারমালিক, মৎস্য কর্মকর্তা ও ভোক্তারা।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টায় কক্সবাজার শহরের ফিশারিঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, বাঁকখালী নদীতে ভিড়েছে ১২ থেকে ১৫টি ট্রলার। প্রতিটি ট্রলার ইলিশে ভর্তি। ব্যবসায়ীরা ট্রলারের ইলিশ ডিঙিনৌকায় ভরে বাজারে নিয়ে আসছেন। পাইকারি বাজারে ৯০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের প্রতিটি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায়, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা এবং ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। ১ কেজির বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায়। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ফিশারিঘাট থেকে চারটি ট্রাকে অন্তত ২১ মেট্রিক টন ইলিশ ঢাকায় সরবরাহ হয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
গতকাল দুপুরে শহরের বাহারছড়া ও বড়বাজার এবং বিকেলে কানাইয়ার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে ১ থেকে ২ কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক কেজির কম ওজনের ইলিশের কেজি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। বেশির ভাগ মানুষ মানুষ ইলিশের দামদর করে ফিরে যাচ্ছেন।
গতকাল দুপুরে ফিশারিঘাটে ইলিশের বাজার ঘুরে দেখতে গিয়েছিল ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ (ক্যাব) কক্সবাজার জেলা সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী। অতিরিক্ত দামে ইলিশ বেচাবিক্রি করতে দেখে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঘের বা খামারের মতো বঙ্গোপসাগরে ইলিশ চাষে কারও বিনিয়োগ করতে হয় না। জাল ফেললেই ধরা পড়ছে হাজার হাজার ইলিশ। এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ ৬০০ টাকা বিক্রি করলেও লাভ থাকে। তারপরও কেন ৬০০ টাকার ইলিশ ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, তা বোধগম্য হচ্ছে না। ইলিশের বাজার তদারকিরও কেউ নেই। যেমন ইচ্ছা, তেমন দামে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ।
সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, কয়েক বছর আগেও এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দালাল চক্র এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা অতিরিক্ত লাভ করতে ইলিশের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন।
মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, ১৪ আগস্ট থেকে কক্সবাজারে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ছে। ২১ আগস্ট পর্যন্ত সাত দিনে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ২ হাজার ১০০ মেট্রিক টন (প্রতিদিন গড়ে ৩০০ মেট্রিক টন)। বৈরী পরিবেশে সাগর উত্তাল থাকায় ২২ থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ৫ দিন কয়েক হাজার ট্রলার সাগরে ইলিশ ধরতে পারেনি। তবে কয়েক শ ট্রলার এই ৫ দিনে অন্তত ৫০০ মেট্রিক টন (দৈনিক ১০০ টন করে) ইলিশ আহরণ করেছে। ২৮ আগস্ট থেকে আবার ইলিশ আহরণ শুরু হয়েছে।
সাগরে বিপুল পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ার পরও অতিরিক্ত দামে বেচাবিক্রির কারণ জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান মধ্যস্বত্বভোগী ও দাদন ব্যবসায়ীদের দুষলেন। তিনি বলেন, ট্রলারের ইলিশ তিন হাত ঘুরে ভোক্তার কাছে পৌঁছায়। তাতে ৬০০ টাকার ইলিশের দাম ১ হাজার ২০০ টাকায় ঠেকছে। ট্রলারের মালিক ইলিশ ধরার জন্য আরেকজনের কাছ থেকে চড়া সুদে দাদন নেন। দাদনদারের আবার এজেন্ট থাকে। এজেন্ট ছাড়া অন্য কাউকে ইলিশ বিক্রি করা যায় না। এজেন্টরা ৬০০ টাকার ইলিশ বাজারে বিক্রি করেন ১ হাজার ২০০ টাকায়। দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পর থেকে ট্রলারমালিকদের মুক্ত কিংবা ট্রলার থেকে আহরিত ইলিশ সরাসরি বাজারে পৌঁছানো গেলে দাম অর্ধেক কমে যেত বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
কক্সবাজার থেকে ট্রাকে প্রতি কেজি ইলিশ ঢাকার বাজারে পৌঁছাতে পরিবহন ও প্যাকেজিং বাবদ খরচ হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ইলিশের বিপরীতে ১০ থেকে ২০ টাকার বেশি লাভ করা যাচ্ছে না বলে দাবি ফিশারিঘাট মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির উপদেষ্টা ও ইলিশ ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীনের। তিনি বলেন, বৈরী পরিবেশে কয়েক দিন ইলিশ আহরণ কমে যাওয়ায় দাম কিছুটা বেড়েছে।
কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, ইলিশের বাজার নিয়ন্ত্রণ হয় ঢাকা থেকে। এ ক্ষেত্রে ট্রলারমালিকদের করার কিছু থাকে না। অধিকাংশ ট্রলার দাদন নিয়ে তৈরি। শর্ত অনুযায়ী আহৃত মাছ তাঁদের হাতে তুলে দিতে হয়। কয়েক হাত ঘুরে ট্রলারের ইলিশ বাজারে পৌঁছতে দাম দ্বিগুণ দাঁড়ায়। জেলায় ইলিশ ধরার ট্রলার আছে ছয় হাজার। অধিকাংশ ট্রলার এখন সাগরে অবস্থান করছে। দু-এক দিনের মধ্যে সব ট্রলার ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরলে দাম কমতে পারে।